Thursday, 28 April 2016

নাচুক তাহাতে শ্যামা


 ফুল্ল ফুল সৌরভে আকুল, মত্ত অলিকুল গুঞ্জরিছে আশে পাশে। শুভ্র শশী যেন হাসিরাশি, যত স্বর্গবাসী বিতরিছে ধরাবাসে ।। মৃদুমন্দ মলয়পবন, যার পরশন, স্মৃতিপট দেয় খুলে। নদী, নদ, সরসী-হিল্লোল, ভ্রমর চঞ্চল, কত বা কমল দোলে ।। ফেনময়ী ঝরে নির্ঝরিণী-তানতরঙ্গিণী-গুহা দেয় প্রতিধ্বনি । স্বরময় পতত্রিনিচয়, লুকায়ে পাতায়, শুনায় সোহাগবাণী ।। চিত্রকর, তরুণ ভাস্কর, স্বর্ণতুলিকর, ছোঁয় মাত্র ধরাপটে। বর্ণখেলা ধরাতল ছায়, রাগপরিচয় ভাবরাশি জেগে ওঠে ।। মেঘমন্দ্র কুলিশ-নিস্বন, মহারণ, ভুলোক-দ্যুলোক-ব্যাপী । অন্ধকার উগরে আঁধার, হুহুঙ্কার শ্বসিছে প্রলয়বায়ু ।। ঝলকি ঝলকি তাহে ভায়, রক্তকায় করাল বিজলীজ্বালা । ফেনময় গর্জি মহাকায়, উর্মি ধায় লঙ্ঘিতে পর্বতচূড়া ।। ঘোষে ভীম গম্ভীর ভূতল, টলমল রসাতল যায় ধরা । পৃথ্বীচ্ছেদি উঠিছে অনল, মহাচল চূর্ণ হয়ে যায় বেগে ।। শোভাময় মন্দির-আলয়, হৃদে নীল পয়, তাহে কুবলয়শ্রেণী । দ্রাক্ষাফল-হৃদয়-রুধির, ফেনশুভ্রশির, বলে মৃদু মৃদু বাণী ।। শ্রুতিপথে বীণার ঝঙ্কার, বাসনা বিস্তার, রাগ তাল মান লয়ে । কতমত ব্রজের উচ্ছ্বাস, গোপী-তপ্তশ্বাস, অশ্রুরাশি পড়ে বয়ে ।। বিম্বফল যুবতী-অধর, ভাবের সাগর—নীলোৎপল দুটি আঁখি । দুটি কর—বাঞ্ছাঅগ্রসর, প্রেমের পিঞ্জর, তাহে বাঁধা প্রাণপাখী ।। ডাকে ভেরী, বাজে ঝর্,‍র্ ঝর্ঞ‍র্ দামামা নক্কাড়, বীর দাপে কাঁপে ধরা। ঘোষে তোপ বব-বব-বম্, বব-বব-বম্ বন্দুকের কড়কড়া ।। ধুমে ধুমে ভীম রণস্থলে, গরজি অনল বমে শত জ্বালামুখী । ফাটে গোলা লাগে বুকে গায়, কোথা উড়ে যায় আসোয়ার ঘোড়া হাতি ।। পৃথ্বীতল কাঁপে থরথর, লক্ষ অশ্ববরপৃষ্ঠে বীর ঝাঁকে রণে। ভেদি ধূম গোলাবরিষণ গুলি স্বন্ স্বন্, শত্রুতোপ আনে ছিনে ।। আগে যায় বীর্য-পরিচয় পতাকা-নিচয়, দণ্ডে ঝরে রক্তধারা । সঙ্গে সঙ্গে পদাতিকদল, বন্দুক প্রবল, বীরমদে মাতোয়ারা ।। ঐ পড়ে বার ধ্বজাধারী, অন্য বীর তারি ধ্বজা লয়ে আগে চলে। তলে তার ঢের হয়ে যায় মৃত বীরকায়, তবু পিছে নাহি টলে ।। দেহ চায় সুখের সঙ্গম, চিত্ত-বিহঙ্গম সঙ্গীত-সুধার ধার। মন চায় হাসির হিন্দোল, প্রাণ সদা লোল যাইতে দুঃখের পার ।। ছাড়ি হিম শশাঙ্কচ্ছটায়, কেবা বল চায়, মধ্যাহ্নপতন-জ্বালা। প্রাণ যার চণ্ড দিবাকর, স্নিগ্ধ শশধর, সেও তবু লাগে ভালো ।। সুখতরে সবাই কাতর, কেবা সে পামর দুঃখে যার ভালবাসা ? সুখে দুঃখ, অমৃতে গরল, কণ্ঠে হলাহল, তবু নাহি ছাড়ে আশা ।। রুদ্রমুখে সবাই ডরায়, কেহ নাহি চায় মৃত্যুরূপা এলোকেশী । উষ্ণধার, রুধির-উদগার, ভীম তরবার খসাইয়ে দেয় বাঁশী ।। সত্য তুমি মৃত্যরূপা কালী, সুখবনমালী তোমার মায়ার ছায়া। করালিনি, কর মর্মচ্ছেদ, হোক মায়াভেদ, সুখস্বপ্ন দেহে দয়া ।। মুণ্ডমালা পরায়ে তোমায়, ভয়ে ফিরে চায়, নাম দেয় দয়াময়ী। প্রাণ কাঁপে, ভীম অট্টহাস, নগ্ন দিক্া‍বাস, বলে মা দানবজয়ী ।। মুখে বলে দেখিবে তোমায়, আসিলে সময় কোথা যায় কেবা জানে। মৃত্যু তুমি, রোগ মহামারী বিষকুম্ভ ভরি, বিতরিছ জনে জনে ।। রে উন্মাদ, আপনা ভুলাও, ফিরে নাহি চাও, পাছে দেখ ভয়ঙ্করা। দুখ চাও, সুখ হবে ব'লে, ভক্তিপূজাছলে স্বার্থ-সিদ্ধি মনে ভরা ।। ছাগকণ্ঠ রুধিরের ধার, ভয়ের সঞ্চার, দেখে তোর হিয়া কাঁপে। কাপুরুষ! দয়ার আধার! ধন্য ব্যবহার! মর্মকথা বলি কাকে ? ভাঙ্গ বীণা-প্রেমসুধাপান, মহা আকর্ষণ-দূর কর নারীমায়া । আগুয়ান, সিন্ধুরোলে গান, অশ্রুজলপান, প্রাণপণ, যাক্ কায়া ।। জাগো বীর, ঘুচায়ে স্বপন, শিয়রে শমন, ভয় কি তোমার সাজে? দুঃখভার, এ ভব-ঈশ্বর, মন্দির তাহার প্রেতভূমি চিতামাঝে ।। পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার, সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তোমা। চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা ।। - 

No comments:

Post a Comment