Friday, 22 April 2016

শ্রীশ্রীমা একবার জয়রামবাটি থেকে দক্ষিণেশ্বরে যাবার পথে ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন। এ ঘটনার বিবরণ যেমন রোমাঞ্চকর তেমনি কৌতূহলোদ্দীপক।


একবার কোন এক উৎসব উপলক্ষ্যে কয়েকজন যাত্রী গঙ্গাস্নান করার উদ্দেশ্যে কামারপুকুর থেকে কলকাতার পথে যাত্রা করেন। শ্রীমাও তাঁর ভাসুরপো ( শিবরাম ) এবং ভাসুরজীকে ( লক্ষীমণিদেবী ) সঙ্গে নিয়ে তাদের সঙ্গী হন। শ্রীমার উদ্দেশ্য ছিলে কলকাতায় গিয়ে তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাবেন এবং সেখানেই থেকে যাবেন। তখন পায়ে হেঁটেই সকলে যেত। কামারপুকুর থেকে যাত্রা করে আট মাইল দূরে আরামবাগে তারা দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যান। এর পরেই বিখ্যাত তেলোভেলোর মাঠ। জায়গাটি ডাকাতদের আড্ডা বলে কুখ্যাত। এ পথে সকলে দল বেঁধে যেতেই চেষ্টা করত। আরামবাগে পৌঁছে যেহেতু হাতে অনেক সময় ছিল, তাই সকলে স্থির করেন তারা তখনই রওনা হয়ে দিনের আলো থাকতেই তেলোভেলোর মাঠটি ছাড়িয়ে যাবেন। শ্রীমা নিজের অসুবিধা হবে জেনেও সকলের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করতে চাইলেন না। এগিয়ে যাওয়াই ঠিক হল। শ্রীমা কিছুক্ষণ পরেই পিছিয়ে পড়তে শুরু করেন এবং সঙ্গীদের দেরী হয়ে যাবে বলে মা তাদের এগিয়ে যেতে বলেন। তারা দ্রুতপায়ে চলে মাকে ফেলে চলে যান। শ্রীমা একা চলতে থাকেন। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কিছু পরে কোঁকড়া চুল ও কালো চেহারার একজন লম্বা লোক লাঠি কাঁধে করে শ্রীমার সামনে এসে হাজির হয় এবং কর্কশ গলায় মা কোথায় যাচ্ছেন জানতে চায়। কিন্তু হঠাৎ লোকটা হাঁ করে মার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং খুব নরম সুরে বলে, "ভয় নেই। আমার সঙ্গে একজন মহিলা আছে। সে পিছিয়ে পড়েছে। এখনই চলে আসবে।" মহিলাটি এলে মা বললেন, "আমি তোমাদের মেয়ে। তোমাদের জামাই দক্ষিণেশ্বরে থাকে। তোমরা আমাকে তার কাছে পৌঁছে দেও।" সেই সরল প্রাণের একান্ত নির্ভরতা দস্যুদম্পতির মন ছুঁয়ে গেল। তারা শ্রীমাকে সে রাতের মত তাদের আশ্রয়ে নিয়ে রাখে এবং পরদিন সকালে বাগদিনী তার স্বামীকে বাজারে গিয়ে মাছ ও সব্জী আনতে বলে। রান্না করে মাকে খাইয়ে তারা যখন তৈরী তখন শ্রীমায়ের সঙ্গীরা মাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে হাজির হন। সেই ডাকাতবাবা ও ডাকাত মা শ্রীমার সঙ্গে তারকেশ্বরের পথে অনেক দূর অবধি যায় এবং মাঠ থেকে কড়াইশুঁটি তুলে বাগদিনী কাতর গলায় বলে, "মা সারদা, রাত্রে যখন মুড়ি খাবি তখন এগুলো দিয়ে খাস।"
পরে শ্রীমাকে অনেকে সেই রাত্রে ডাকাতের হঠাৎ মনের পরিবর্তন সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলেন। শ্রীআশুতোষ মিত্র প্রণীত 'শ্রীমা' গ্রন্থে ডাকাতের ঘটনা এইভাবে লেখা হয়েছে - শ্রীমা বলিতেছেন, "লোকটা জাতে বাগদী, ডাকাতের মতো রুক্ষ গলায় জিজ্ঞাসা করলে,'তুই কে ?' আর আমার পানে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।" যাঁহার সহিত শ্রীমায়ের কথা হইতেছিল, সেই ভক্ত মায়ের কথা শুনিয়া জানিতে চাহিলেন, "ডাকাত আপনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কি দেখছিল ?" শ্রীমা -" পরে বলেছিল, কালীরূপে না কি দেখেছিল।" ভক্ত - "তাহলে আপনি কালীরূপে তাকে দেখা দিয়েছিলেন ? লুকোবেন না, মা, বলুন।" শ্রীমা - "আমি কেন দেখাতে যাব। সে বললে, সে দেখেছে।" ভক্ত - "তা হলেই হল - আপনি দেখিয়েছিলেন।" শ্রীমা (সহাস্যে) - "তা তুমি যাই বল না কেন ?"
এই ডাকাতের নাম সাগর সাঁতরা এবং তার স্ত্রী মাতঙ্গিনী। এই ঘটনার পরে সাগর আর কখনও ডাকাতি করে নি। পরে তারা কয়েকবারই দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছে এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ লাভ করে ধন্য হয়েছে। তাদের দুই ছেলে বিহারী ও মেহারী শ্রীমায়ের কাছে মন্ত্রদীক্ষা লাভ করে। ১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে সাগর সাঁতরা বেল গাছ থেক্লে পড়ে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যায়। তেলুয়া ও ভালিয়া ( সংক্ষেপে তেলো ও ভেলো ) দুটি পাশাপাশি গ্রাম। দুই গ্রামের মধ্যবর্তী মাঠই তেলোভেলোর মাঠ।

No comments:

Post a Comment