Sunday, 15 May 2016

সন্ন্যাসীর গীতি

উঠাও সন্ন্যাসী, উঠাও সে তান,হিমাদ্রী-শিখরে উঠিল যে গান –গভীর অরণ্যে, পর্বত-প্রদেশে,সংসারের তাপ যথা নাহি পশে –যে সঙ্গীত-ধ্বনি-প্রশান্ত-লহরীসংসারের রোল উঠে ভেদ করি ;কাঞ্চন কি কাম কিংবা যশ-আশযাইতে না পারে কভু যার পাশ,যথা সত্য-জ্ঞান-আনন্দ-ত্রিবেণী –সাধু যায় স্নান করে ধন্য মানি –উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,গাও গাও গাও, গাও সেই গান –ওঁ তৎ সৎ ওঁ২ভেঙ্গে ফেল শীঘ্র চরণ-শৃঙ্খল –সোনার নির্মিত হলে কি দুর্বল,হে ধীমান, তারা তোমার বন্ধনে ?ভাঙ্গ শীঘ্র তাই ভাঙ্গ প্রাণপণে।ভালবাসা-ঘৃণা, ভাল-মন্দ-দ্বন্দ্ব,ত্যজহ উভয়ে, উভয়েই মন্দ।আদর দাসেরে, কশাঘাত কর,দাসত্ব-তিলক ভালের উপর ;স্বাধীনতা-বস্তু কখন জানে না,স্বাধীন আনন্দ কভু তো বুঝে না।তাই বলি, ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,দূর কর দুয়ে অতীব সত্বর ;কর কর গান, কর নিরন্তর –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৩যাক অন্ধকার, যাক সেই তমঃ,আলেয়ার মত বুদ্ধির বিভ্রমঘটায়ে আঁধার হইতে আঁধারেল’য়ে যায় এই ভ্রান্ত জীবাত্মারে।জীবনের এই তৃষা চিরতরেমিটাও জ্ঞানের বারি পান করে।এই তম-রজ্জু জীবাত্মা-পশুরেজন্মমৃত্যু-মাঝে আকর্ষণ করে।সে-ই সব জিনে – নিজে জিনে যেই,ফাঁদে পা দিও না জেনে তত্ত্ব এই।বলহ সন্ন্যাসি, বল বীর্যবান্,করহ আনন্দে কর এই গান –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৪‘কৃত কর্মফল ভুঞ্জিতে হইবে,’বলে লোকে, ‘হেতু কার্য প্রসবিবে,শুভ কর্মে – শুভ, মন্দে – মন্দফল,এ নিয়ম রোধে নাই কারো বল।এ মর-জগতে সাকার যে জন,শৃঙ্খল তাহার অঙ্গের ভূষণ।’সত্য সব, কিন্তু নামরূপ-পারেনিত্যমুক্ত আত্মা আনন্দ বিহরে।জানো ‘তত্ত্বমসি’, করো না ভাবনা –করহ সন্ন্যাসি, সদাই ঘোষণা –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৫সত্য কিবা তারা জানে না কখন,সদাই যাহারা দেখয়ে স্বপন –পিতা মাতা জায়া অপত্য বান্ধব –আত্মা তো কখন নহে এই সব ;নাহি তাহে কোনো লিঙ্গালিঙ্গভেদনাহিক জনম, নাহি খেদাখেদ।কার পিতা তবে, কাহার সন্তান ?কার বন্ধু, শত্রু কাহার ধীমান ?একমাত্র যেবা – যেবা সর্বময়,যাহা বিনা কোনো অস্তিত্বই নয়,‘তত্ত্বমসি’, ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,উচ্চরবে তাই এই তান ধর –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৬একমাত্র মুক্ত জ্ঞাতা আত্মা হয়,অনাম অরূপ অক্লেদ নিশ্চয় ;তাঁহার আশ্রয়ে এ মোহিনী মায়াদেখিছে এসব স্বপনের ছায়া ;সাক্ষীর স্বরূপ – সদাই বিদিত,প্রকৃতি জীবাত্মারূপে প্রকাশিত ;‘তত্ত্বমসি’, ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,ধর ধর ধর, উচ্চে তান ধর –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৭অন্বেষিছ মুক্তি কোথা বন্ধুবর ?পাবে না তো হেথা, কিম্বা এর পর ;শাস্ত্রে বা মন্দিরে বৃথা অন্বেষণ ;নিজ হস্তে রজ্জু – যাহে আকর্ষণ।ত্যজ অতএব বৃথা শোকরাশি,ছেড়ে দাও রজ্জু, বল হে সন্ন্যাসি –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৮দাও দাও দাও সবারে অভয়,বল, ‘প্রাণিজাত, করো নাকো ভয় ;ত্রিবিদ পাতাল থাকো যে যেখান,সকলের আত্মা আমি বিদ্যমান ;স্বরগ-নরক ইহমুত্র-ফলআশা ভয় আমি ত্যজিনু সকল।’এইরূপে কাটো মায়ার বন্ধন ;গাও গাও গাও করে প্রাণপণ –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৯ভেবো না দেহের হয় কিবা গতি,থাকে কিম্বা যায় – অনন্ত নিয়তি –কার্য-অবশেষ হয়েছে উহার,এবে ওতে প্রারব্ধের অধিকার ;কেহ বা উহারে মালা পরাইবে,কেহ বা উহারে পদ প্রহারিবে ;চিত্তের প্রশান্তি ভেঙ্গো না কখন,সদাই আনন্দে রহিবে মগন ;কোথা অপযশ – কোথা বা সুখ্যাতি ?স্তাবক-স্তাব্যের একত্ব-প্রতীতি,অথবা নিন্দুক-নিন্দ্যের যেমতি।জানি এ একত্ব-আনন্দ অন্তরেগাও হে সন্ন্যাসি, নির্ভীক অন্তরে –ওঁ তৎ সৎ ওঁ১০পশিতে পারে না কভু তথা সত্যকাম-লোভ-বশে যেই হৃদি মত্ত ;কামিনীতে করে স্ত্রীবুদ্ধি যে জন,হয় না তাহার বন্ধন-মোচন ;কিম্বা কিছু দ্রব্যে যার অধিকার,হউক সামান্য – বন্ধন অপার ;ক্রোধের শৃঙ্খল কিম্বা পায়ে যার,হইতে না পারে কভু মায়া পার।ত্যজ অতএব, এসব বাসনা,আনন্দে সদাই কর হে ঘোষণা –ওঁ তৎ সৎ ওঁ১১সুখতরে গৃহ করো না নির্মাণ,কোন্ গৃহ তোমা ধরে, হে মহান্ ?গৃহছাদ তব অনন্ত আকাশ,শয়ন তোমার সুবিস্তৃত ঘাস ;দৈববশে প্রাপ্ত যাহা তুমি হও,সেই খাদ্যে তুমি পরিতৃপ্ত রও ;হউক কুৎসিত, কিম্বা সুরন্ধিত,ভুঞ্জহ সকলি হয়ে অবিকৃত।শুদ্ধ আত্মা যেই জানে আপনারেকোন্ খাদ্য-পেয় অপবিত্র করে ?হও তুমি চল-স্রোতস্বতী মত,স্বাধীন উন্মুক্ত নিত্য-প্রবাহিত।উঠাও আনন্দে, উঠাও সে তান,গাও গাও গাও সদা এই গান –ওঁ তৎ সৎ ওঁ১২তত্ত্বজ্ঞের সংখ্যা মুষ্টিমেয় হয়,অ-তত্ত্বজ্ঞ তোমা হাসিবে নিশ্চয় ;হে মহান, তোমা করিবেক ঘৃণা,তাহাদের দিকে চেয়েও দেখো না।স্বাধীন, উন্মুক্ত – যাও স্থানে স্থানে,অজ্ঞান হইতে উদ্ধারো অজ্ঞানে –মায়া-আবরণে ঘোর অন্ধকারে,নিয়তই যারা যন্ত্রণায় মরে।বিপদের ভয় করো না গণনা,সুখ-অন্বেষণে যেন হে মেতো না ;যাও এ উভয় দ্বন্দ্ব-ভূমি-পারেগাও গাও গাও, গাও উচ্চস্বরে –ওঁ তৎ সৎ ওঁ১৩এইরূপে বন্ধো, দিন পরে দিন,করমের শক্তি হয়ে যাবে ক্ষীণ ;আত্মার বন্ধন ঘুচিয়া যাইবে,জনম তাহার আর না হইবে ;আমি বা আমার কোথায় তখন ?ঈশ্বর – মানব – তুমি – পরিজন ?সকলেতে আমি – আমাতে সকল –আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ কেবল।সে আনন্দ তুমি, ওহে বন্ধুবর,তাই হে আনন্দে ধর তান ধর –ওঁ তৎ সৎ ওঁ

No comments:

Post a Comment