"ওঁ যথাগ্নের্দাহিকা শক্তিঃ রামকৃষ্ণে স্থিতা হি যা।
সর্ববিদ্যাস্বরূপাং তাং সারদাং প্রণমাম্যহম।।"
শ্রীমায়ের হৃদয় দেশের দুঃখদুর্দশায় বিচলিত হইত; সময়বিশেষে বিদেশী শাসকের শোষণনীতির প্রতিবাদে তাঁহার চক্ষে অগ্নিস্ফুরণ কিংবা অশ্রুবিসর্জন হইত। কিন্তু সমস্ত দুঃখদৈন্যের একমাত্র প্রতিকার রূপে তিনি সর্বদা শ্রীরামকৃষ্ণকে ধরিয়া থাকিতেন এবং অপরকেও তাহাই করিতে বলিতেন। বস্তুত তাঁহার সমস্ত চিন্তা ও কার্য ছিল রামকৃষ্ণ-কেন্দ্রিক।
তখন স্বদেশীর যুগ; তাই জনৈক দেশভক্ত যখন জিজ্ঞাসা করিলেন, "মা, এদেশের দুঃখ-দুর্দশা কি দূর হবে না?" তখন শ্রীমা উত্তর দিয়াছিলেন যে, ঠাকুর ঐ জন্যই আসিয়াছিলেন। সুতরাং কোয়ালপাড়ার ভক্তদের কর্মোদ্যমে আকৃষ্ট হইলেও তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, আশ্রমের অধিষ্ঠাতৃরূপে শ্রীরামকৃষ্ণেরই বিরাজমান থাকা আবশ্যক, নতুবা কর্মীরা অচিরে পথভ্রষ্ট হইতে পারেন। তাই তিনি কলকাতা যাইবার পথে আশ্রমে ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিলেন।
অগ্রহায়ণের আরম্ভ। তখন ভোরে খুব ঠান্ডা হইলেও শ্রীমাকে কোয়ালপাড়ায় গিয়া পূজা করিতে হইবে। তাই তিনি সূর্যোদয়ের পূর্বেই পালকিতে রওয়ানা হইলেন। লক্ষ্মীদিদি, শ্রীমায়ের ভ্রাতুষ্পুত্রী মাকু ও রাধু এবং রাধুর স্বামী মন্মথ ভিন্ন ভিন্ন পালকিতে যাত্রা করিলেন। ছোটমামী, নলিনীদিদি, ভুদেব প্রভৃতি অন্যান্য সকলে গোযানে উঠিলেন এবং ব্রহ্মচারী প্রকাশ মহারাজ সকলের তত্ত্বাবধায়ক রূপে চলিলেন।
কোয়ালপাড়া আশ্রমে শ্রীমা ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করিবেন বলিয়া ভক্তবৃন্দ যথাসাধ্য আয়োজন করিয়াছেন। মা আশ্রমে পৌঁছিয়া স্নান সারিয়া আসিলেন এবং বেদিতে শ্রীশ্রীঠাকুরের ও আপনার ফটো স্থাপনপূর্বক যথাবিধি পূজা করিলেন। তাঁহার আদেশে কিশোরী মহারাজ হোমাদি করিলেন। পূজাশেষে সকলে প্রসাদ পাইলেন।
ইহার পর মধ্যাহ্ন ভোজনের পূর্বে কেদারবাবুর মা, লক্ষ্মীদিদি ও নলিনীদিদির সহিত শ্রীমা কেদারবাবুদের বাড়িতে পদব্রজে বেড়াইতে গেলেন। প্রকাশ মহারাজ ইহা শুনিয়া বিরক্ত হইয়া আশ্রমবাসীদিগকে বলিলেন, "তোমরা মার মর্যাদা কিছুই জান না। আমাকে না বলে তাঁকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেলে কেন? যাই হোক, মাকে ফেরবার সময় পালকি করে নিয়ে এসো।"
এই বলিয়া নিজেই পালকি, বেহারা ও আশ্রমবাসী দুইজনকে লইয়া কেদারবাবুর বাড়ির দিকে চলিলেন। মধ্য পথে মাতাঠাকুরানীর সহিত দেখা হইলে প্রকাশ মহারাজ তাঁহাকে পালকিতে উঠিয়া বসিতে অনুরোধ করিলেন।
শ্রীমা বিরক্তির সহিত উঠিলেন বটে, কিন্তু আশ্রমে আসিয়াই তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, "এ আমাদের পাড়াগাঁ। কোয়ালপাড়া হলো আমার বৈঠকখানা। এইসব ছেলেরা আমার আপনার লোক। আমি এদেশে এসে একটু স্বাধীনভাবে চলব ফিরব। কলকাতা থেকে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। তোমরা তো সেখানে আমাকে খাঁচার ভিতর পুরে রাখ আমাকে সর্বদা সঙ্কুচিত হয়ে থাকতে হয়। এখানেও যদি তোমাদের কথামত পা-টি বাড়াতে হয়, তা আমি পারব না - শরৎকে লিখে দাও।"
তখন প্রকাশ মহারাজ ক্ষমা চাহিয়া কহিলেন যে, তাঁহার নিজের দিক হইতে যাহাতে ত্রুটি না হয়, ঐরূপ করিতে গিয়াই তিনি অজ্ঞাতসারে মায়ের স্বাধীনতাকে খর্ব করিয়া ফেলিয়াছেন।
স্থির হইল যে, সন্ধ্যা ছয়টার পূর্বেই পুনরায় যাত্রা আরম্ভ হইবে। অতএব রাস্তার খাবার উহার আগেই প্রস্তুত রাখিতে হইবে। কিন্তু আশ্রমবাসীদের যথাশক্তি চেষ্টা সত্ত্বেও সময়মত কাজ শেষ হইল না। প্রকাশ মহারাজ ইহাতে বিরক্ত হইতেছেন দেখিয়া আশ্রমবাসীরা পরামর্শ দিলেন যে, কলকাতার যাত্রীরা রওয়ানা হইয়া যাইতে পারেন; পরে যেমন করিয়াই হউক পথে খাবার পৌঁছাইয়া দেওয়া হইবে।
শ্রীমা সকল কথা শুনিয়া প্রকাশ মহারাজকে বলিলেন, "তুমি মাথা গরম করে এত রাগারাগি করছ কেন? এ আমাদের পাড়াগাঁ, কলকাতার মতো এখানে কি সব ঘড়ির কাঁটায় হয়ে ওঠে? দেখছ সকাল থেকে ছেলেরা কি খাটাই খাটছে! তুমি যাই বল না কেন, এখান থেকে না খেয়ে যাওয়া হবে না।" শেষে আহারাদির পর রাত্রি আন্দাজ আটটায় আটখানি গরুর গাড়িতে সকলে বিষ্ণুপুর অভিমুখে যাত্রা করিলেন।
"জননীং সারদাং দেবীং রামকৃষ্ণং জগদ্গুরুম্।
পাদপদ্মে তয়ো শ্রিত্বা প্রণমামি মুহুর্মুহুঃ।।"
No comments:
Post a Comment