Tuesday, 31 May 2016

বাণী ও রচনা--স্বামী বিবেকানন্দ

যদি এই ব্রহ্মাণ্ড অনন্ত শক্তির বিকাশ হয়, তবে প্রলয়কালেও সেই অনন্ত শক্তি সঙ্কুচিতভাবে থাকিবে,ইহা স্বীকার করিতে হইবে ৷ অন্য কোন ভাব সম্ভব নয় ৷ অতএব ইহা নিশ্চিত যে,প্রত্যেক আত্মাই  অনন্ত ৷ আমাদের পদতলসঞ্চারী ক্ষুদ্রতম কীট হইতে মহত্তম সাধু পর্যন্ত সকলেরই ভিতর অনন্ত শক্তি, অনন্ত পবিত্রতা ও সমুদয় গুণই অনন্ত পরিমাণে রহিয়াছে ৷ প্রভেদ কেবল প্রকাশের তারতম্যে ৷ কীটে সেই মহাশক্তির অতি অল্প পরিমাণ বিকাশ হইয়াছে, তোমাতে তাহা অপেক্ষা অধিক, আবার অপর একজন দেবতুল্য মানবে তাহা অপেক্ষা অধিকতর শক্তির বিকাশ হইয়াছে -- এইমাত্র প্রভেদ ৷ কিন্তু সকলের মধ্যেই সেই এক শক্তি রহিয়াছে ৷...... কেবল এই কপাট, দেহরূপ এই কপাট আমাদের যথার্থ ও পূর্ণ বিকাশ হইতে দিতেছে না ৷ আর যতই এই দেহের গঠন উন্নত হইতে থাকে,যতই তমোগুণ রজেগুণে এবং রজোগুণ সত্ত্বগুণে পরিণত হয়,   ততই এই শক্তি  ও শুদ্ধত্ব প্রকাশিত হইতে  থাকে;  এই জন্যই আমরা পানাহার সম্বন্ধে এত সাবধান ৷

বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড,  পৃ: ৩১২

Monday, 30 May 2016

শিক্ষা (২)..... স্বামী বিবেকানন্দ

এই জগতে আমরা যে-সকল জ্ঞানলাভ করি, তাহারা কোথা হইতে আসে? উহারা আমাদের ভিতরেই রহিয়াছে ৷ কোন জ্ঞান কি বাহিরে আছে? -- আমাকে এক বিন্দু দেখাও তো ৷ জ্ঞান কখনো জড়ে ছিল না, উহা বরাবর মানুষের ভিতরেই ছিল ৷ জ্ঞান কেহ কখনো সৃষ্টি করে নাই; মানুষ উহা আবিষ্কার করে, ভিতর হইতে উহাকে বাহির করে, উহা ভিতরেই রহিয়াছে ৷ এই যে ক্রোশব্যাপী বৃহৎ বটবৃক্ষ, তাহা ঐ সর্ষপবীজের অষ্টমাংশের তুল্য ক্ষুদ্র বীজে ছিল -- ঐ মহাশক্তিরাজি উহার ভিতরে নিহিত রহিয়াছে ৷ আমরা জানি, একটি জীবাণুকোষের ভিতর সকল শক্তি, প্রখর বুদ্ধি কুণ্ডলীকৃত হইয়া অবস্থান করে; তবে অনন্ত শক্তি কেন না তাহাতে থাকিতে পারিবে? আমরা জানি, তাহা আছে ৷..... আমাদের ভিতর  শক্তি পূর্ব হইতেই অন্তর্নিহিত ছিল অব্যক্তভাবে, কিন্তু উহা ছিল নিশ্চয়ই ৷

বাণী ও রচনা, ২য় খণ্ড, পৃ: ২৭১-৭২

Sunday, 29 May 2016

প্রেম..... স্বামী বিবেকানন্দ

প্রেমকে আমরা একটি ত্রিকোণরূপে প্রকাশ করিতে পারি, উহার কোণগুলিই যেন উহার তিনটি অবিভাজ্য বৈশিষ্ট্যের প্রকাশক ৷ তিনটি কোণ ব্যতীত একটি ত্রিকোণ বা ত্রিভুজ সম্ভব নয় আর এই তিনটি লক্ষ্মণ ব্যতীত প্রকৃত প্রেমও সম্ভব নয় ৷ প্রেমরূপ এই ত্রিকোণের একটি কোণ : প্রেমে কোন দর-কষাকষি বা কেনাবেচার ভাব নাই ৷ যেখানে কোন প্রতিদানের আশা থাকে, সেখানে প্রকৃত প্রেম সম্ভব নয়;  সে-ক্ষেত্রে  উহা কেবল দোকানদারিতে পরিণত হয় ৷.... কোন বরলাভের জন্য, এমন কি মুক্তিলাভের জন্যও ভগবানের উপাসনা করা অধম উপাসনা! প্রেম কোন পুরস্কার চায় না, প্রেম সর্বদা প্রেমেরই জন্য ৷..... প্রেমরূপ ত্রিকোণের দ্বিতীয় কোণ : প্রেমে কোনরূপ ভয় নাই ৷ যাহারা ভগবানকে ভয়ে ভালবাসে,তাহারা মনুষ্যাধম; তাহাদের মনুষ্যভাব এখনও পূর্ণ বিকশিত হয় নাই ৷ তাহারা শাস্তির ভয়ে ভগবানকে উপাসনা করে ৷..... ভগবানকে দণ্ডের ভয়ে উপাসনা করা অতি নিম্নশ্রেণীর উপাসনা ৷..... প্রেম স্বভাবতই সমুদয় ভয়কে জয় করিয়া ফেলে ৷...... প্রেমরূপ ত্রিকোণের তৃতীয় কোণ : প্রেমে প্রতিদ্বন্দ্বীর স্থান নাই ৷ প্রেমিকের আর দ্বিতীয় ভালবাসার পাত্র থাকিবে না, কারণ প্রেমেই প্রেমিকের সর্বোচ্চ আদর্শ রূপায়িত ৷ যতদিন না ভালবাসার পাত্র আমাদের সর্বোচ্চ আদর্শ হইয়া দাঁড়ায়, ততদিন প্রকৃত প্রেম সম্ভব নয় ৷
বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, (ভক্তিযোগ)

পুণ্যভূমি ভারত-স্বামী বিবেকানন্দ

ভারত পুণ্যভূমি, কর্মভূমি ৷.... যদি এই পৃথিবীর মধ্যে এমন কোন দেশ থাকে,যাহাকে 'পুণ্যভূমি' নামে বিশেষিত করা যাইতে পারে -- যদি এমন কোন স্থান থাকে যেখানে পৃথিবীর সকল জীবকেই তাহার কর্মফল ভুগিতে আসিতে হইবে -- যেখানে ঈশ্বরের অভিমুখী জীবমাত্রকেই পরিণামে আসিতে হইবে -- যেখানে মনুষ্যজাতির ভিতর সর্বাপেক্ষা অধিক ক্ষমা, দয়া, পবিত্রতা, শান্তভাব প্রভৃতি সদ্ গুণের বিকাশ হইয়াছে -- যদি এমন কোন দেশ থাকে, যেখানে সর্বাপেক্ষা অধিক আধ্যাত্মিকতা ও অন্তর্দৃষ্টির বিকাশ হইয়াছে, তবে নিশ্চয় বলিতে পারি, তাহা আমাদের মাতৃভূমি -- এই ভারতবর্ষ ৷ অতি প্রাচীনকাল হইতেই এখানে বিভিন্ন ধর্মের সংস্থাপকগণ আবির্ভূত হইয়া সমগ্র পৃথিবীকে বারংবার সনাতন ধর্মের পবিত্র আধ্যাত্মিক বন্যায় ভাসাইয়া দিয়াছেন ৷ এখান হইতেই উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম -- সর্বত্র দার্শনিক জ্ঞানের প্রবল তরঙ্গ বিস্তৃত  হইয়াছে ৷ আবার এখান হইতে তরঙ্গ উত্থিত হইয়া পৃথিবীর জড়বাদী সভ্যতাকে আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ করিবে ৷ অন্যান্য দেশের লক্ষ লক্ষ নরনারীর হৃদয়দগ্ধকারী জড়বাদরূপ  অনল নির্বান করিতে যে জীবনপ্রদ বারির প্রয়োজন, তাহা এখানেই রহিয়াছে ৷ বন্ধুগণ,  বিশ্বাস করুন ভারতই আবার পৃথিবীকে আধ্যাত্মিক তরঙ্গে প্লাবিত করিবে ৷
বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড, (ভারতে বিবেকানন্দ )

শিক্ষা----স্বামী বিবেকানন্দ (১)

যে-কোন উপদেশ দুর্বলতা শিক্ষা দেয়, তাহাতে আমার বিশেষ আপত্তি; নর-নারী, বালক - বালিকা যখন দৈহিক মানসিক বা আধ্যাত্মিক শিক্ষা পাইতেছে, আমি তাহাদিগকে এই এক প্রশ্ন করিয়া থাকি -- তোমরা কি বল পাইতেছ? কারণ আমি জানি, একমাত্র সত্যই বল বা শক্তি প্রদান করে ৷ আমি জানি, সত্যই একমাত্র প্রাণপ্রদ, সত্যের দিকে না গেলে আমরা কিছুতেই বীর্যবান হইব না, আর বীর না হইলে সত্যেও  যাওয়া যাইবে না ৷ এইজন্যই যে-কোন মত, যে-কোন শিক্ষাপ্রণালী মনকে ও মস্তিষ্ককে দুর্বল করিয়া ফেলে, মানুষকে কুসংস্কারাবিষ্ট করিয়া তোলে, যাহাতে মানুষ অন্ধকারে হাতড়াইয়া বেড়ায়, যাহা সর্বদাই মানুষকে সকলপ্রকার বিকৃতমস্তিষ্কপ্রসূত অসম্ভব আজগুবী ও কুসংস্কারপূর্ণ বিষয়ের অন্বেষণ করায় -- আমি সেই প্রণালীগুলি পছন্দ করি না, কারণ মানুষের উপর তাহাদের প্রভাব বড় ভয়ানক, আর সেগুলিতে কিছুই উপকার হয় না, সেগুলি নিতান্ত নিষ্ফল ৷
বাণী ও রচনা, ২য় খণ্ড,  পৃ: ২১৬ (জ্ঞানযোগ)

Friday, 27 May 2016

Quotation of Swamiji..........

My boy, when death is inevitable, is it not better to die like heroes than as stocks and stones? And what is the use of living a day or two more in this transitory world? It is better to wear out than  to rust out --- specially for the sake of doing the least good to others. 

Tuesday, 17 May 2016

যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে



চেতনা - অন্তঃকরণবৃত্তি, জ্ঞানাত্মিকা মনোবৃত্তি ৷ চেতনা স্থূলে নামরূপ আকারে পরিব্যক্ত; সূক্ষ্মে প্রাণশক্তিরূপে এবং কারণে অব্যক্ত বীজরূপে অবস্থিত মা চৈতন্যরূপিণী ৷

'সারদে জ্ঞানদায়িকে ৷' শ্রীমা ছিলেন প্রজ্ঞা ও বিদ্যারূপিণী এবং জ্ঞানদায়িনী ৷ তিনি বহু নরনারীকে দীক্ষা ও উপদেশের দ্বারা তাদের অন্তর্নিহিত চৈতন্যকে জাগিয়ে দিয়েছেন ৷ শাস্ত্র বলেন, 'জ্ঞানাদেব মুক্তিঃ' (জ্ঞানেই মুক্তি )৷ মা বলেছেন : ''বাসনাই সকল দুঃখের মূল, বার বার জন্মমৃত্যুর কারণ,  আর মুক্তিপথের অন্তরায় ৷..... নির্বাসনা যদি হতে পার, এক্ষুনি (তত্ত্বজ্ঞান) হয় ৷''

মা অন্তরঙ্গদের আশীর্বাদ করতেন, ''জ্ঞান চৈতন্য হোক ৷'' কোনও সন্তানদের বক্ষঃস্থল ও মস্তকে জপ করে দিতেন;  দু একস্থলে পৃষ্ঠদেশে হাত  বুলিয়ে 'কুণ্ডলিনী জাগুক' বলে আশীর্বাদ করতেন ৷

শ্রীমা সারদা আর সাধু নাগ মহাশয়


বেলা আন্দাজ দশটা ৷ ভক্তশ্রেষ্ঠ নাগ মহাশয় আসিয়াছেন - শ্রীমার দর্শনে ৷ তাঁহাকে দেখিয়া শ্রীমাকে সংবাদ দিলে তিনি প্রসাদ হাতে ভক্তের জন্য সিঁড়ির নিকট পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া আসিয়া অপেক্ষা করিতে থাকেন ৷ এদিকে নাগ মহাশয় শ্রীমার বাটীর সদর দরজা হইতে '' মহামায়ী, মহামায়ী '' শব্দ করিতে করিতে সাষ্টাঙ্গে অগ্রসর  হইতে থাকিলেন - সমস্ত সিঁড়িটিও সেই ভাবে উঠিলেন ৷ উপরে পৌঁছিলে শ্রীমা '' এস বাবা, এস'' বলিলে তিনি ''মহামায়ী, মহামায়ী'' বলিয়া মাথা খুঁড়িয়া প্রণাম করিলেন ৷ শ্রীমা ছাদের  সিঁড়ির প্রথম ধাপটিতে বসিয়া তাঁহাকে উঠিতে বলিলে তিনি নতজানু হইলেন - সর্বাঙ্গ কাঁপিতেছে, নয়নদ্বয় হইতে ধারার পর ধারা নির্গত হইয়া গণ্ডযুগল বহিয়া পরিতেছে ৷ শ্রীমা বলিলেন  : '' এস, ঠাকুরের প্রসাদ পাও ৷'' তিনি বলিলেন : ''মহামায়ীর প্রসাদ !'' শ্রীমা নিজের জিহ্বায় একটুকু ঠেকাইয়া প্রসাদ করিয়া দিলে  তিনি মুখ খুলিলেন ৷ শ্রীমা তাঁহাকে একটু একটু করিয়া খাওয়াইতে থাকিলেন আর তিনি বালকের ন্যায় খাইতে লাগিলেন ৷ গণ্ডদ্বয় প্লাবিত হইতে থাকিল ৷ প্রসাদ খাওয়াইয়া শ্রীমা জল এক এক ঢোক করিয়া মুখে দিতে থাকিলেন আর তিনি খাইতে থাকিলেন ৷ এইপ্রকারে প্রসাদ খাওয়াইবার পর শ্রীমা হাত ধুইয়া আসিয়া দক্ষিণ হস্ত তাঁহার মস্তকে স্পর্শ করাইয়া আশীর্বাদ করিলে তিনি ''মহামায়ী, মহামায়ী'' কহিতে কহিতে বরাবর পাছু হটিয়া অবতরণ করিলেন ৷ আর শ্রীমা যতক্ষণ তাঁহাকে দেখা যায়,  ততক্ষণ অনিমেষনয়নে দেখিতে লাগিলেন  ৷ -- এ এক অপার্থিব দৃশ্য! 

Monday, 16 May 2016

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী....................


নিজের উপর বিশ্বাস না আসিলে ঈশ্বরে বিশ্বাস আসে না। ভাবিও না তোমরা দরিদ্র, ভাবিও না তোমরা বন্ধুহীন; কে কোথায় দেখিয়াছে টাকায় মানুষ করিয়াছে! মানুষই চিরকাল টাকা করিয়া থাকে। জগতের যা কিছু উন্নতি, সব মানুষের শক্তিতে হয়েছে, উৎসাহের শক্তিতে হইয়াছে। বিশ্বাসের শক্তিতে হইয়াছে। প্রাচীন ধর্ম বলিত, যে ঈশ্বরে বিশ্বাস না করে সে নাস্তিক। নতুন ধর্ম বলিতেছে, যে আপনাতে বিশ্বাস স্থাপন না করে সে ই নাস্তিক।
নিজের উপর বিশ্বাস-ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস। ইহাই উন্নতি লাভের একমাত্র উপায়। তোমার যদি এ দেশীয় পুরাণের তেত্রিশ কোটি দেবতার উপর এবং বৈদেশিকেরা মধ্যে মধ্যে যে সকল দেবতার আমদানি করিয়াছে, তাহাদের সবগুলির উপরই বিশ্বাস থাকে ,অথচ যদি তোমার আত্মবিশ্বাস না থাকে, তবে তোমার কখনই মুক্তি হইবে না। নিজের উপর বিশ্বাস সম্পন্ন হও - সেই বিশ্বাসসম্পন্ন হও - সেই বিশ্বাসবলে নিজের পায়ে নিজে দাড়াও এবং বীর্যবান হও।
মানুষকে সর্বদা তাহার দুর্বলতার বিষয় ভাবিতে বলা তাহার দুর্বলতার প্রতীকার নয়- তাহার শক্তির কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়াই প্রতিকারের উপায়। তাহার মধ্যে যে শক্তি পূর্ব হইতে বিরাজিত ,তাহার বিষয় স্মরণ করাইয়া দাও।
সাফল্য লাভ করিতে হইলে প্রবল অধ্যবসায় ,প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি থাকা চাই। অধ্যবসায়শীল সাধক বলেন,' আমি গণ্ডূষে সমুদ্র পান করিব। আমার ইচ্ছামাত্র পর্বত চূর্ণ হইয়া যাইবে।' এইরূপ তেজ, এইরূপ সংকল্প আশ্রয় করিয়া খুব দৃঢ়ভাবে সাধন কর। নিশ্চয়ই লক্ষে উপনীত হইবে।
তোমাদের স্নায়ু সতেজ কর। আমাদের আবশ্যক - লৌহের মত পেশী ও বজ্রদৃঢ় স্নায়ু। আমরা অনেক দিন ধরিয়া কাঁদিয়াছি; এখন আর কাদিবার প্রয়োজন নাই, এখন নিজের পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া মানুষ হও।
পৃথিবীর ইতিহাস কয়েকজন আত্মবিশ্বাসী মানুষেরই ইতিহাস। সেই বিশ্বাসই ভিতরের দেবত্ব জাগ্রত করে। তুমি সব কিছু করিতে পার।
মনে করিও না, তোমরা দরিদ্র। অর্থই বল নহে ; সাধুতাই-পবিত্রতাই বল। আপনাতে বিশ্বাস রাখো। প্রবল বিশ্বাসই বড় কাজের জনক।
হে বীরহৃদয় যুবকগণ ,তোমরা বিশ্বাস কর যে ,তোমরা বড় বড় কাজ করবার জন্য জন্মেছ। ওঠ, জাগো, আর ঘুমিও না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের ভিতরেই আছে। এ কথা বিশ্বাস করো, তা হলেই ঐ শক্তি জেগে উঠবে।

শ্রীমা--নানা ভাবে


শ্রীমা রঙ্গরসে বিশেষ পটু ছিলেন ৷ দুইটি চরিত্রবিশেষ অবলম্বন করিয়া একসময়ে এমন পারদর্শিতার সহিত হাতমুখ নাড়িয়া বর্ণনা করেন, যেন বোধ হয় সত্যই অভিনয় করিতেছেন ৷ কিন্তু ঐরূপ করিতে করিতে অকস্মাৎ গম্ভীর হইয়া বলেন  : ''আমার ছেলেরা যেন কেউ ওরকম না হয় ৷ নেড়ানেড়ীর দল সৃষ্টি করার চেয়ে েন ববে করে গিয়ে ৷ আমার অনুমতি রইল ৷'' ঐ ব্যক্তিদ্বয়ের মধ্যে একজন কালে-ভদ্রে শ্রীমাকে প্রণাম করিতে আসিতেন ৷  শ্রীমা, কয়েকটি অন্তরঙ্গ ব্যতীত যেভাবে সচরাচর চাদর মুড়ি দিয়া দাঁড়াইয়া প্রণাম গ্রহণ করিতেন,  এক্ষেত্রেও তাহাই করিতেন এবং সে-লোকটি প্রণাম করিয়া চলিয়া গেলে, আমরা একাধিকবার লক্ষ্য করিয়াছি, শ্রীমাকে তাঁহার চাদর ও কাপড়ে গঙ্গাজল ছিটাইবার পর চরণদ্বয় গঙ্গাজলে ধুইতে ৷

Sunday, 15 May 2016

শ্রীশ্রীমায়ের জীবনের কথা



একবার শ্রীমা কলিকাতায় আসিলে তাঁহার শরীরে বসন্ত দেখা দেয় ৷ বাগবাজার স্ট্রীটের এক শীতলার পূজারীর চিকিৎসাধীন থাকেন ৷ নিত্য সে-ব্রাহ্মণ আসিত এবং নিত্য তাহার বিদায়কালে শ্রীমা গলবস্ত্রা হইয়া তাহার পদধূলি গ্রহণ করিতেন ৷ শ্রীমাকে ঐ চরিত্রহীন ব্রাহ্মণের  পদধূলি লইতে দেখিয়া আমরা বড়ই ব্যথিত হই ৷ থাকিতে না পারিয়া একদিন শ্রীমাকে ঐরূপ করিতে নিষেধও করিয়া বসি ৷ তিনি উত্তরে  বলেন : '' কি জান বাবা, হাজার হোক ব্রাহ্মণ -- ভেকের মান দেওয়াই উচিত ৷ ঠাকুর তো আর ভাঙতে আসেননি  ৷''

সন্ন্যাসীর গীতি

উঠাও সন্ন্যাসী, উঠাও সে তান,হিমাদ্রী-শিখরে উঠিল যে গান –গভীর অরণ্যে, পর্বত-প্রদেশে,সংসারের তাপ যথা নাহি পশে –যে সঙ্গীত-ধ্বনি-প্রশান্ত-লহরীসংসারের রোল উঠে ভেদ করি ;কাঞ্চন কি কাম কিংবা যশ-আশযাইতে না পারে কভু যার পাশ,যথা সত্য-জ্ঞান-আনন্দ-ত্রিবেণী –সাধু যায় স্নান করে ধন্য মানি –উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,গাও গাও গাও, গাও সেই গান –ওঁ তৎ সৎ ওঁ২ভেঙ্গে ফেল শীঘ্র চরণ-শৃঙ্খল –সোনার নির্মিত হলে কি দুর্বল,হে ধীমান, তারা তোমার বন্ধনে ?ভাঙ্গ শীঘ্র তাই ভাঙ্গ প্রাণপণে।ভালবাসা-ঘৃণা, ভাল-মন্দ-দ্বন্দ্ব,ত্যজহ উভয়ে, উভয়েই মন্দ।আদর দাসেরে, কশাঘাত কর,দাসত্ব-তিলক ভালের উপর ;স্বাধীনতা-বস্তু কখন জানে না,স্বাধীন আনন্দ কভু তো বুঝে না।তাই বলি, ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,দূর কর দুয়ে অতীব সত্বর ;কর কর গান, কর নিরন্তর –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৩যাক অন্ধকার, যাক সেই তমঃ,আলেয়ার মত বুদ্ধির বিভ্রমঘটায়ে আঁধার হইতে আঁধারেল’য়ে যায় এই ভ্রান্ত জীবাত্মারে।জীবনের এই তৃষা চিরতরেমিটাও জ্ঞানের বারি পান করে।এই তম-রজ্জু জীবাত্মা-পশুরেজন্মমৃত্যু-মাঝে আকর্ষণ করে।সে-ই সব জিনে – নিজে জিনে যেই,ফাঁদে পা দিও না জেনে তত্ত্ব এই।বলহ সন্ন্যাসি, বল বীর্যবান্,করহ আনন্দে কর এই গান –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৪‘কৃত কর্মফল ভুঞ্জিতে হইবে,’বলে লোকে, ‘হেতু কার্য প্রসবিবে,শুভ কর্মে – শুভ, মন্দে – মন্দফল,এ নিয়ম রোধে নাই কারো বল।এ মর-জগতে সাকার যে জন,শৃঙ্খল তাহার অঙ্গের ভূষণ।’সত্য সব, কিন্তু নামরূপ-পারেনিত্যমুক্ত আত্মা আনন্দ বিহরে।জানো ‘তত্ত্বমসি’, করো না ভাবনা –করহ সন্ন্যাসি, সদাই ঘোষণা –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৫সত্য কিবা তারা জানে না কখন,সদাই যাহারা দেখয়ে স্বপন –পিতা মাতা জায়া অপত্য বান্ধব –আত্মা তো কখন নহে এই সব ;নাহি তাহে কোনো লিঙ্গালিঙ্গভেদনাহিক জনম, নাহি খেদাখেদ।কার পিতা তবে, কাহার সন্তান ?কার বন্ধু, শত্রু কাহার ধীমান ?একমাত্র যেবা – যেবা সর্বময়,যাহা বিনা কোনো অস্তিত্বই নয়,‘তত্ত্বমসি’, ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,উচ্চরবে তাই এই তান ধর –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৬একমাত্র মুক্ত জ্ঞাতা আত্মা হয়,অনাম অরূপ অক্লেদ নিশ্চয় ;তাঁহার আশ্রয়ে এ মোহিনী মায়াদেখিছে এসব স্বপনের ছায়া ;সাক্ষীর স্বরূপ – সদাই বিদিত,প্রকৃতি জীবাত্মারূপে প্রকাশিত ;‘তত্ত্বমসি’, ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,ধর ধর ধর, উচ্চে তান ধর –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৭অন্বেষিছ মুক্তি কোথা বন্ধুবর ?পাবে না তো হেথা, কিম্বা এর পর ;শাস্ত্রে বা মন্দিরে বৃথা অন্বেষণ ;নিজ হস্তে রজ্জু – যাহে আকর্ষণ।ত্যজ অতএব বৃথা শোকরাশি,ছেড়ে দাও রজ্জু, বল হে সন্ন্যাসি –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৮দাও দাও দাও সবারে অভয়,বল, ‘প্রাণিজাত, করো নাকো ভয় ;ত্রিবিদ পাতাল থাকো যে যেখান,সকলের আত্মা আমি বিদ্যমান ;স্বরগ-নরক ইহমুত্র-ফলআশা ভয় আমি ত্যজিনু সকল।’এইরূপে কাটো মায়ার বন্ধন ;গাও গাও গাও করে প্রাণপণ –ওঁ তৎ সৎ ওঁ৯ভেবো না দেহের হয় কিবা গতি,থাকে কিম্বা যায় – অনন্ত নিয়তি –কার্য-অবশেষ হয়েছে উহার,এবে ওতে প্রারব্ধের অধিকার ;কেহ বা উহারে মালা পরাইবে,কেহ বা উহারে পদ প্রহারিবে ;চিত্তের প্রশান্তি ভেঙ্গো না কখন,সদাই আনন্দে রহিবে মগন ;কোথা অপযশ – কোথা বা সুখ্যাতি ?স্তাবক-স্তাব্যের একত্ব-প্রতীতি,অথবা নিন্দুক-নিন্দ্যের যেমতি।জানি এ একত্ব-আনন্দ অন্তরেগাও হে সন্ন্যাসি, নির্ভীক অন্তরে –ওঁ তৎ সৎ ওঁ১০পশিতে পারে না কভু তথা সত্যকাম-লোভ-বশে যেই হৃদি মত্ত ;কামিনীতে করে স্ত্রীবুদ্ধি যে জন,হয় না তাহার বন্ধন-মোচন ;কিম্বা কিছু দ্রব্যে যার অধিকার,হউক সামান্য – বন্ধন অপার ;ক্রোধের শৃঙ্খল কিম্বা পায়ে যার,হইতে না পারে কভু মায়া পার।ত্যজ অতএব, এসব বাসনা,আনন্দে সদাই কর হে ঘোষণা –ওঁ তৎ সৎ ওঁ১১সুখতরে গৃহ করো না নির্মাণ,কোন্ গৃহ তোমা ধরে, হে মহান্ ?গৃহছাদ তব অনন্ত আকাশ,শয়ন তোমার সুবিস্তৃত ঘাস ;দৈববশে প্রাপ্ত যাহা তুমি হও,সেই খাদ্যে তুমি পরিতৃপ্ত রও ;হউক কুৎসিত, কিম্বা সুরন্ধিত,ভুঞ্জহ সকলি হয়ে অবিকৃত।শুদ্ধ আত্মা যেই জানে আপনারেকোন্ খাদ্য-পেয় অপবিত্র করে ?হও তুমি চল-স্রোতস্বতী মত,স্বাধীন উন্মুক্ত নিত্য-প্রবাহিত।উঠাও আনন্দে, উঠাও সে তান,গাও গাও গাও সদা এই গান –ওঁ তৎ সৎ ওঁ১২তত্ত্বজ্ঞের সংখ্যা মুষ্টিমেয় হয়,অ-তত্ত্বজ্ঞ তোমা হাসিবে নিশ্চয় ;হে মহান, তোমা করিবেক ঘৃণা,তাহাদের দিকে চেয়েও দেখো না।স্বাধীন, উন্মুক্ত – যাও স্থানে স্থানে,অজ্ঞান হইতে উদ্ধারো অজ্ঞানে –মায়া-আবরণে ঘোর অন্ধকারে,নিয়তই যারা যন্ত্রণায় মরে।বিপদের ভয় করো না গণনা,সুখ-অন্বেষণে যেন হে মেতো না ;যাও এ উভয় দ্বন্দ্ব-ভূমি-পারেগাও গাও গাও, গাও উচ্চস্বরে –ওঁ তৎ সৎ ওঁ১৩এইরূপে বন্ধো, দিন পরে দিন,করমের শক্তি হয়ে যাবে ক্ষীণ ;আত্মার বন্ধন ঘুচিয়া যাইবে,জনম তাহার আর না হইবে ;আমি বা আমার কোথায় তখন ?ঈশ্বর – মানব – তুমি – পরিজন ?সকলেতে আমি – আমাতে সকল –আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ কেবল।সে আনন্দ তুমি, ওহে বন্ধুবর,তাই হে আনন্দে ধর তান ধর –ওঁ তৎ সৎ ওঁ

Friday, 13 May 2016

সপ্তভূমি -- অহংকার কখন যায় -- ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা

[
“জ্ঞানলাভ হলে অহংকার যেতে পারে। জ্ঞানলাভ হলে সমাধিস্থ হয়। সমাধিস্থ হলে তবে অহং যায়। সে জ্ঞানলাভ বড় কঠিন।

“বেদে আছে যে, সপ্তমভূমিতে মন গেলে তবে সমাধি হয়। সমাধি হলেই তবে অহং চলে যেতে পারে। মনের সচরাচর বাস কোথায়? প্রথম তিনভূমিতে। লিঙ্গ, গুহ্য, নাভি -- সেই তিনভূমি, তখন মনের আসক্তি কেবল সংসারে -- কামিনী-কাঞ্চনে। হৃদয়ে যখন মনের বাস হয়, তখন ঈশ্বরীয় জ্যোতিঃদর্শন হয়। সে ব্যক্তি জ্যোতিঃদর্শন করে বলে ‘একি!’ ‘একি!’ তারপর কণ্ঠ। সেখানে যখন মনের বাস হয়, তখন কেবল ঈশ্বরীয় কথা কহিতে ও শুনিতে ইচ্ছা হয়। কপালে -- ভ্রূমধ্যে -- মন গেলে তখন সচ্চিদানন্দরূপে দর্শন হয়, সেই রূপের সঙ্গে আলিঙ্গন স্পর্শন করতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু পারে না। লণ্ঠনের ভিতর আলো দর্শন হয় কিন্তু স্পর্শ হয় না; ছুঁই ছুঁই বোধ হয়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না। সপ্তমভূমিতে মন যখন যায়, তখন অহং আর থাকে না -- সমাধি হয়।”

বিজয় -- সেখানে পৌঁছিবার পর যখন ব্রহ্মজ্ঞান হয়, মানুষ কি দেখে?

শ্রীরামকৃষ্ণ -- সপ্তমভূমিতে মন পৌঁছিলে কি হয় মুখে বলা যায় না।

“জাহাজ একবার কালাপানিতে গেলে আর ফিরে না। জাহাজের খপর পাওয়া যায় না। সমুদ্রের খপরও জাহাজের কাছে পাওয়া যায় না।

“নুনের ছবি সমুদ্র মাপতে গিছিল। কিন্তু যাই নেমেছে, অমনি গলে গেছে! সমুদ্র কত গভীর কে খপর দিবেক? যে দিবে, সে মিশে গেছে। সপ্তমভূমিতে মনের নাশ হয়, সমাধি হয়। কি বোধ হয়, মুখে বলা যায় না।”

Thursday, 12 May 2016

- : শ্রী শ্রী মায়ের জীবনকথা : -



"ওঁ যথাগ্নের্দাহিকা শক্তিঃ রামকৃষ্ণে স্থিতা হি যা।
সর্ববিদ্যাস্বরূপাং তাং সারদাং প্রণমাম্যহম।।"

   শ্রীমায়ের হৃদয় দেশের দুঃখদুর্দশায় বিচলিত হইত; সময়বিশেষে বিদেশী শাসকের শোষণনীতির প্রতিবাদে তাঁহার চক্ষে অগ্নিস্ফুরণ কিংবা অশ্রুবিসর্জন হইত। কিন্তু সমস্ত দুঃখদৈন্যের একমাত্র প্রতিকার রূপে তিনি সর্বদা শ্রীরামকৃষ্ণকে ধরিয়া থাকিতেন এবং অপরকেও তাহাই করিতে বলিতেন। বস্তুত তাঁহার সমস্ত চিন্তা ও কার্য ছিল রামকৃষ্ণ-কেন্দ্রিক।

   তখন স্বদেশীর যুগ; তাই জনৈক দেশভক্ত যখন জিজ্ঞাসা করিলেন, "মা, এদেশের দুঃখ-দুর্দশা কি দূর হবে না?" তখন শ্রীমা উত্তর দিয়াছিলেন যে, ঠাকুর ঐ জন্যই আসিয়াছিলেন। সুতরাং কোয়ালপাড়ার ভক্তদের কর্মোদ্যমে আকৃষ্ট হইলেও তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, আশ্রমের অধিষ্ঠাতৃরূপে শ্রীরামকৃষ্ণেরই বিরাজমান থাকা আবশ্যক, নতুবা কর্মীরা অচিরে পথভ্রষ্ট হইতে পারেন। তাই তিনি কলকাতা যাইবার পথে আশ্রমে ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিলেন।

   অগ্রহায়ণের আরম্ভ। তখন ভোরে খুব ঠান্ডা হইলেও শ্রীমাকে কোয়ালপাড়ায় গিয়া পূজা করিতে হইবে। তাই তিনি সূর্যোদয়ের পূর্বেই পালকিতে রওয়ানা হইলেন। লক্ষ্মীদিদি, শ্রীমায়ের ভ্রাতুষ্পুত্রী মাকু ও রাধু এবং রাধুর স্বামী মন্মথ ভিন্ন ভিন্ন পালকিতে যাত্রা করিলেন। ছোটমামী, নলিনীদিদি, ভুদেব প্রভৃতি অন্যান্য সকলে গোযানে উঠিলেন এবং ব্রহ্মচারী প্রকাশ মহারাজ সকলের তত্ত্বাবধায়ক রূপে চলিলেন।

   কোয়ালপাড়া আশ্রমে শ্রীমা ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করিবেন বলিয়া ভক্তবৃন্দ যথাসাধ্য আয়োজন করিয়াছেন। মা আশ্রমে পৌঁছিয়া স্নান সারিয়া আসিলেন এবং বেদিতে শ্রীশ্রীঠাকুরের ও আপনার ফটো স্থাপনপূর্বক যথাবিধি পূজা করিলেন। তাঁহার আদেশে কিশোরী মহারাজ হোমাদি করিলেন। পূজাশেষে সকলে প্রসাদ পাইলেন।

   ইহার পর মধ্যাহ্ন ভোজনের পূর্বে কেদারবাবুর মা, লক্ষ্মীদিদি ও নলিনীদিদির সহিত শ্রীমা কেদারবাবুদের বাড়িতে পদব্রজে বেড়াইতে গেলেন। প্রকাশ মহারাজ ইহা শুনিয়া বিরক্ত হইয়া আশ্রমবাসীদিগকে বলিলেন, "তোমরা মার মর্যাদা কিছুই জান না। আমাকে না বলে তাঁকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেলে কেন? যাই হোক, মাকে ফেরবার সময় পালকি করে নিয়ে এসো।" 

   এই বলিয়া নিজেই পালকি, বেহারা ও আশ্রমবাসী দুইজনকে লইয়া কেদারবাবুর বাড়ির দিকে চলিলেন। মধ্য পথে মাতাঠাকুরানীর সহিত দেখা হইলে প্রকাশ মহারাজ তাঁহাকে পালকিতে উঠিয়া বসিতে অনুরোধ করিলেন। 

   শ্রীমা বিরক্তির সহিত উঠিলেন বটে, কিন্তু আশ্রমে আসিয়াই তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, "এ আমাদের পাড়াগাঁ। কোয়ালপাড়া হলো আমার বৈঠকখানা। এইসব ছেলেরা আমার আপনার লোক। আমি এদেশে এসে একটু স্বাধীনভাবে চলব ফিরব। কলকাতা থেকে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। তোমরা তো সেখানে আমাকে খাঁচার ভিতর পুরে রাখ আমাকে সর্বদা সঙ্কুচিত হয়ে থাকতে হয়। এখানেও যদি তোমাদের কথামত পা-টি বাড়াতে হয়, তা আমি পারব না - শরৎকে লিখে দাও।"

   তখন প্রকাশ মহারাজ ক্ষমা চাহিয়া কহিলেন যে, তাঁহার নিজের দিক হইতে যাহাতে ত্রুটি না হয়, ঐরূপ করিতে গিয়াই তিনি অজ্ঞাতসারে মায়ের স্বাধীনতাকে খর্ব করিয়া ফেলিয়াছেন।

   স্থির হইল যে, সন্ধ্যা ছয়টার পূর্বেই পুনরায় যাত্রা আরম্ভ হইবে। অতএব রাস্তার খাবার উহার আগেই প্রস্তুত রাখিতে হইবে। কিন্তু আশ্রমবাসীদের যথাশক্তি চেষ্টা সত্ত্বেও সময়মত কাজ শেষ হইল না। প্রকাশ মহারাজ ইহাতে বিরক্ত হইতেছেন দেখিয়া আশ্রমবাসীরা পরামর্শ দিলেন যে, কলকাতার যাত্রীরা রওয়ানা হইয়া যাইতে পারেন; পরে যেমন করিয়াই হউক পথে খাবার পৌঁছাইয়া দেওয়া হইবে।

   শ্রীমা সকল কথা শুনিয়া প্রকাশ মহারাজকে বলিলেন, "তুমি মাথা গরম করে এত রাগারাগি করছ কেন? এ আমাদের পাড়াগাঁ, কলকাতার মতো এখানে কি সব ঘড়ির কাঁটায় হয়ে ওঠে? দেখছ সকাল থেকে ছেলেরা কি খাটাই খাটছে! তুমি যাই বল না কেন, এখান থেকে না খেয়ে যাওয়া হবে না।" শেষে আহারাদির পর রাত্রি আন্দাজ আটটায় আটখানি গরুর গাড়িতে সকলে বিষ্ণুপুর অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

"জননীং সারদাং দেবীং রামকৃষ্ণং জগদ্‌গুরুম্।
পাদপদ্মে তয়ো শ্রিত্বা প্রণমামি মুহুর্মুহুঃ।।"

Wednesday, 11 May 2016

Quotes by Sarada Devi.....

Quotes by Sarada Devi

As wind removes a cloud, so does the name of God disperse the cloud of worldliness

As you smell the fragrance of a flower by handing it or the smell of sandalwood by rubbing it against a stone, so you obtain spiritual awakening by constantly thinking of God.

One must be patient like the earth. What iniquities are being perpetuated on her! Yet she quietly endures them all.

Each has to get the result of the actions one has earned for this life. A pin at least must prick where a wound from a sword was due.

You see, my son, it is not a fact that you will never face danger. Difficulties always come, but they do not last forever. You will see that they pass away like water under a bridge.

Don’t be afraid. Human birth is full of suffering and one has to endure everything patiently, taking the name of God. None, not even God in human form, can escape the sufferings of body and mind.
I tell you one thing my child — if you want peace, do not find fault with others. Rather, see your own faults. Learn to make the world your own. No one is a stranger, my child; the whole world is your own.
(From Sri Sarada Devi’s last words, spoken before passing away on July 20, 1920)

To err is human. One must not take that into account. It is harmful for oneself. One gets into the habit of finding fault…

To make mistakes is man’s very nature; but few of those who criticize know how to correct them.

It is in the very nature of man to see defects. You should learn to appreciate virtues. Man is no doubt liable to err, but you must not take notice. If you constantly find fault with others, you will see faults alone.’ … `Do not look at the faults of others lest your eyes should become vitiated.’

Do not look for faults in others, or your own eyes will become faulty.

Let me tell you how to love all equally,” said Mother. “Do not demand anything from those you love. If you make demands, some will give you more and some less. In any case you will love more those who give you more and less those who give you less. Thus your love will not be the same for all. You will not be able to love all impartially.

After someone finished her sweeping and threw the broom into a corner, Mother said, “How strange, my dear! The work is finished, and you throw it away carelessly. It takes almost the same time to put it away slowly and carefully as to throw it away. Should you despise a thing just because it is insignificant? ‘Him that you save, saves you in turn.’ Won’t you need it again? Besides, this thing too forms a part of our household. From that point of view also it deserves some consideration. You must give each one his due share of honour. Even a broom must be shown some honor. The smallest work must be done with reverence.

I am the mother of the wicked, as I am the mother of the virtuous. Never fear. Whenever you are in distress, say to yourself, ‘I have a mother.’

I can never refuse anyone who addresses me as Mother.

জ্ঞানীর মতে অসংখ্য অবতার -- কুটীচক -- তীর্থ কেন


ঠাকুর অনন্ত ও অনন্ত ঈশ্বর -- সকলই পন্থা -- শ্রীবৃন্দাবন-দর্শন

[জ্ঞানীর মতে অসংখ্য অবতার -- কুটীচক -- তীর্থ কেন]

শ্রীরামকৃষ্ণ -- জ্ঞানীরা নিরাকার চিন্তা করে। তারা অবতার মানে না। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে স্তব করছেন, তুমি পূর্ণব্রহ্ম; কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, আমি পূর্ণব্রহ্ম কি না দেখবে এস। এই বলে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে বললেন, তুমি কি দেখছ? অর্জুন বললে, আমি এক বৃহৎ গাছ দেখছি, -- তাতে থোলো থোলো কালো জামের মতো ফল ফলে রয়েছে। কৃষ্ণ বললেন, আরও কাছে এস দেখ দেখি ও থোলো থোলো ফল নয় -- থোলো থোলো কৃষ্ণ অসংখ্য ফলে রয়েছে -- আমার মতো। অর্থাৎ সেই পূর্ণব্রহ্মরূপ থেকে অসংখ্য অবতার হচ্ছে যাচ্ছে।

“কবীর দাসের নিরাকারের উপর খুব ঝোঁক ছিল। কৃষ্ণের কথায় কবীর দাস বলত, ওঁকে কি ভজব? -- গোপীরা হাততালি দিত আর উনি বানর নাচ নাচতেন! (সহাস্যে) আমি সাকারবাদীর কাছে সাকার, আবার নিরাকারবাদীর কাছে নিরাকার।”

মণি (সহাস্যে) -- যাঁর কথা হচ্ছে তিনিও (ঈশ্বর) যেমন অনন্ত, আপনিও তেমনি অনন্ত! -- আপনার অন্ত পাওয়া যায় না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) -- তুমি বুঝে ফেলেছ! -- কি জানো -- সব ধর্ম একবার করে নিতে হয়। -- সব পথ দিয়ে চলে আসতে হয়। খেলার ঘুঁটি সব ঘর না পার হলে কি চিকে উঠে? -- ঘুঁটি যখন চিকে উঠে কেউ তাকে ধরতে পারে না।

মণি -- আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ -- যোগী দুই প্রকার, -- বহুদক আর কুটীচক। যে সাধু অনেক তীর্থ করে বেড়াচ্ছে -- যার মনে এখনও শান্তি হয় নাই, তাকে বহুদক বলে। যে-যোগী সব ঘুরে মন স্থির করেছে, যার শান্তি হয়ে গেছে -- সে এক জায়গায় আসন করে বসে -- আর নড়ে না। সেই এক স্থানে বসেই তার আনন্দ। তার তীর্থে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন করে না যদি সে তীর্থে যায়, সে কেবল উদ্দীপনের জন্য।

“আমায় সব ধর্ম একবার করে নিতে হয়েছিল -- হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান আবার শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্ত -- এ-সব পথ দিয়েও আসতে হয়েছে। দেখলাম, সেই এক ঈশ্বর -- তাঁর কাছেই সকলি আসছে -- ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে।

“তীর্থে গেলাম তা এক-একবার ভারী কষ্ট হত। কাশীতে সেজোবাবুদের বৈঠকখানায় গিয়েছিলাম। সেখানে দেখি তারা বিষয়ের কথা কচ্ছে! -- টাকা, জমি, এই সব কথা। কথা শুনে আমি কাঁদতে লাগলাম। বললাম, মা, কোথায় আনলি! দক্ষিণেশ্বরে যে আমি বেশ ছিলাম। পইরাগে দেখলাম, সেই পুকুর, সেই দুর্বা, সেই গাছ, সেই তেতুঁল পাতা! কেবল তফাত পশ্চিমে লোকের ভুষির মতো বাহ্য। (ঠাকুর ও মণির হাস্য)

“তবে তীর্থে উদ্দীপন হয়ে বটে। মথুরবাবুর সঙ্গে বৃন্দাবনে গেলাম। মথুরবাবুর বাড়ির মেয়েরাও ছিল -- হৃদেও ছিল। কালীয়দমন ঘাট দেখবামাত্রই উদ্দীপন হত -- আমি বিহ্বল হয়ে যেতাম! -- হৃদে আমায় যমুনার সেই ঘাটে ছেলেটির মতন নাওয়াত।

“যমুনার তীরে সন্ধ্যার সময়ে বেড়াতে যেতাম। যমুনার চড়া দিয়ে সেই সময় গোষ্ঠ হতে গরু সব ফিরে আসত। দেখবামাত্র আমার কৃষ্ণের উদ্দীপন হল, উন্মত্তের ন্যায় আমি দৌড়তে লাগলাম -- ‘কৃষ্ণ কই, কৃষ্ণ কই’ এই বলতে বলতে!

“পালকি করে শ্যামকুণ্ড রা ধাকুণ্ডের পথে যাচ্ছি, গোবর্ধন দেখতে নামলাম, গোবর্ধন দেখবামাত্রই একেবারে বিহ্বল, দৌড়ে গিয়ে গোবর্ধনের উপরে দাঁড়িয়ে পড়লুম। -- আর বাহ্যশূন্য হয়ে গেলাম। তখন ব্রজবাসীরা গিয়ে আমায় নামিয়া আনে। শ্যামকুণ্ড রাধাকুণ্ড পথে সেই মাঠ, আর গাছপালা, পাখি, হরিণ -- এই সব দেখে বিহ্বল হয়ে গেলাম। চক্ষের জলে কাপড় ভিজে যেতে লাগল। মনে হতে লাগল, কৃষ্ণ রে, সবই রয়েছে, কেবল তোকে দেখতে পাচ্ছি না। পালকির ভিতরে বসে, কিন্তু একবার একটি কইবার শক্তি নাই -- চুপ করে বসে! হৃদে পালকির পিছনে আসছিল। বেয়ারাদের বলে দিল ‘খুব হুঁশিয়ার।’

“গঙ্গামায়ী বড় যত্ন করত। অনেক বয়স। নিধুবনের কাছে কুটিরে একলা থাকত। আমার অবস্থা আর ভাব দেখে, বলত -- ইনি সাক্ষাৎ রাধা দেহধারণ করে এসেছেন। আমায় ‘দুলালী’ বলে ডাকত! তাকে পেলে আমার খাওয়া-দাওয়া, বাসায় ফিরে যাওয়া সব ভুল হয়ে যেত। হৃদে এক-একদিন বাসা থেকে খাবার এনে খাইয়ে যেত -- সেও খাবার জিনিস তয়ের করে খাওয়াত।

“গঙ্গামায়ীর ভাব হত। তার ভাব দেখবার জন্য লোকের মেলা হত। ভাবেতে একদিন হৃদের কাঁধে চড়েছিল।

“গঙ্গামায়ীর কাছ থেকে দেশে চলে আসবার আমার ইচ্ছা ছিল না। সব ঠিক-ঠাক, আমি সিদ্ধ চালের ভাত খাব; -- গঙ্গামায়ীর বিছানা ঘরের এদিকে হবে, আমার বিছানা ওদিকে হবে। সব ঠিক-ঠাক। হৃদে তখন বললে, তোমার এত পেটের অসুখ -- কে দেখবে? গঙ্গামায়ী বললে, কেন, আমি দেখব, আমি সেবা করব। হৃদে একহাত ধরে টানে আর গঙ্গামায়ী একহাত ধরে টানে -- এমন সময় মাকে মনে পড়ল! -- মা সেই একলা দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়ির নবতে। আর থাকা হল না। তখন বললাম, না, আমায় যেতে হবে!

“বৃন্দাবনের বেশ ভাবটি। নতুন যাত্রী গেলে ব্রজ বালকেরা বলতে থাকে, ‘হরি বোলো, গাঁঠরী খোলো!’

বেলা এগারটার পর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মা-কালীর প্রসাদ গ্রহণ করিলেন। মধ্যাহ্নে একটু বিশ্রাম করিয়া বৈকালে আবার ভক্তদের সঙ্গে কথাবার্তায় কাটাইতেছেন -- কেবল মধ্যে মধ্যে এক-একবার প্রণবধ্বনি বা “হা চৈতন্য” এই নাম উচ্চারণ করিতেছেন।

ঠাকুরবাড়িতে সন্ধ্যার আরতি হইল। আজ বিজয়া, শ্রীরামকৃষ্ণ কালীঘরে আসিয়াছেন, মাকে প্রণামের পর ভক্তেরা তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিলেন। রামলাল মা-কালীর আরতি করিয়াছেন। ঠাকুর রামলালকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “ও রামনেলো! কই রে!”

মা-কালীর কাছে সিদ্ধি নিবেদন করা হইয়াছে। ঠাকুর সেই প্রসাদ স্পর্শ করিবেন -- সেইজন্য রামলালকে ডাকিতেছেন। আর আর ভক্তদের সকলকে একটু দিতে বলিতেছেন।

Monday, 9 May 2016

এ সংসার কেন?



ত্রিভির্গুণয়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্বমিদং জগৎ ৷
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্‌ ৷৷
                                                                                [গীতা -- ৭।১৩]
এ সংসার কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবাদির প্রতি) -- বন্ধন আর মুক্তি -- দুয়ের কর্তাই তিনি। তাঁর মায়াতে সংসারী জীব কামিনী-কাঞ্চনে বদ্ধ, আবার তাঁর দয়া হলেই মুক্ত। তিনি “ভববন্ধনের বন্ধনহারিণী তারিণী”।

এই বলিয়া গন্ধর্বনিন্দিতকন্ঠে রামপ্রসাদের গান গাহিতেছেন:

শ্যামা মা উড়াচ্ছ ঘুড়ি (ভবসংসার বাজার মাঝে) ৷
(ওই যে) আশা-বায়ু ভরে উড়ে, বাঁধা তাহে মায়া দড়ি ৷৷
কাক গণ্ডি মণ্ডি গাঁথা, পঞ্জরাদি নানা নাড়ী ৷
ঘুড়ি স্বগুণে নির্মাণ করা, কারিগরি বাড়াবাড়ি ৷৷
বিষয়ে মেজেছ মাঞ্জা, কর্কশা হয়েছে দড়ি ৷
ঘুড়ি লক্ষের দুটা-একটা কাটে, হেসে দাও মা হাত-চাপড়ি ৷৷
প্রসাদ বলে, দক্ষিণা বাতাসে ঘুড়ি যাবে উড়ি ৷
ভবসংসার সমুদ্রপারে পড়বে গিয়ে তাড়াতাড়ি ৷৷

“তিনি লীলাময়ী! এ-সংসার তাঁর লীলা। তিনি ইচ্ছাময়ী, আনন্দময়ী। লক্ষের মধ্যে একজনকে মুক্তি দেন।”

ব্রাহ্মভক্ত -- মহাশয়, তিনি তো মনে করলে সকলকে মুক্ত করতে পারেন। কেন তবে আমাদের সংসারে বদ্ধ করে রেখেছেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ -- তাঁর ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছা যে, তিনি এইসব নিয়ে খেলা করেন। বুড়ীকে আগে থাকতে ছুঁলে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। সকলেই যদি ছুঁয়ে ফেলে, খেলা কেমন করে হয়? সকলেই ছুঁয়ে ফেললে বুড়ি অসন্তুষ্ট হয়। খেলা চললে বুড়ীর আহ্লাদ। তাই “লক্ষের দুটো-একটা কাটে, হেসে দাও মা হাত-চাপড়ি।” (সকলের আনন্দ)

“তিনি মনকে আঁখি ঠেরে ইশারা করে বলে দিয়েছেন, ‘যা, এখন সংসার করগে যা।’ মনের কি দোষ? তিনি যদি আবার দয়া করে মনকে ফিরিয়া দেন, তাহলে বিষয়বুদ্ধির হাত থেকে মুক্তি হয়। তখন আবার তাঁর পাদপদ্মে মন হয়।”

ঠাকুর সংসারীর ভাবে মার কাছে অভিমান করে গাইতেছেন:

        আমি ওই খেদ খেদ করি ৷
    তুমি মাতা থাকতে আমার জাগা ঘরে চুরি ৷৷
    মনে করি তোমার নাম করি, কিন্তু সময়ে পাসরি ৷
আমি বুঝেছি জেনেছি, আশয় পেয়েছি এ-সব তোমারি চাতুরী ৷৷
কিছু দিলে না, পেলে না, নিলে না, খেলে না, সে দোষ কি আমারি ৷
যদি দিতে পেতে, নিতে খেতে, দিতাম খাওয়াতাম তোমারি ৷৷
    যশ, অপজশ, সুরস, কুরস সকল রস তোমারি ৷
    (ওগো) রসে থেকে রসভঙ্গ, কেন কর রসেশ্বরী ৷৷
    প্রসাদ বলে, মন দিয়েছ, মনেরি আঁখি ঠারি ৷
(ওমা) তোমার সৃষ্টি দৃষ্টি-পোড়া, মিষ্টি বলে ঘুরি ৷৷

“তাঁরই মায়াতে ভুলে মানুষ সংসারী হয়েছে। ‘প্রসাদ বলে মন দিয়েছে, মনেরি আঁখি ঠারি’।”

[কর্মযোগ সম্বন্ধে শিক্ষা -- সংসার ও নিষ্কামকর্ম ]

ব্রাহ্মভক্ত -- মহাশয়, সব ত্যাগ না করলে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) -- নাগো! তোমাদের সব ত্যাগ করতে হবে কেন? তোমরা রসে-বসে বেশ আছ। সা-রে-মা-তে! (সকলের হাস্য) তোমরা বেশ আছ। নক্স খেলা জানো? আমি বেশি কাটিয়ে জ্বলে গেছি। তোমরা খুব সেয়ানা। কেউ দশে আছো; কেউ ছয়ে আছো; কেউ পাঁচে আছো। বেশি কাটাও নাই; তাই আমার মতো জ্বলে যাও নাই। খেলা চলছে -- এ তো বেশ। (সকলের হাস্য)

“সত্য বলছি, তোমরা সংসার করছ এতে দোষ নাই। তবে ঈশ্বরের দিকে মন রাখতে হবে। তা না হলে হবে না। একহাতে কর্ম কর, আর-একহাতে ঈশ্বরকে ধরে থাক। কর্ম শেষ হলে দুইহাতে ঈশ্বরকে ধরবে।

“মন নিয়ে কথা। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত। মন যে-রঙে ছোপাবে সেই রঙে ছুপবে। যেমন ধোপাঘরের কাপড়। লালে ছোপাও লাল, নীলে ছোপাও নীল, সবুজ রঙে ছোপাও সবুজ। যে-রঙে ছোপাও সেই রঙেই ছুপবে। দেখ না, যদি একটু ইংরেজী পড়, তো অমনি মুখে ইংরেজী কথা এসে পড়ে। ফুট-ফাট, ইট-মিট্‌। (সকলের হাস্য) আবার পায়ে বুটজুতা, শিস দিয়ে গান করা; এই সব এসে জুটবে। আবার যদি পণ্ডিত সংস্কৃত পড়ে অমনি শোলোক ঝাড়বে। মনকে যদি কুসঙ্গে রাখ তো সেরকম কথাবার্তা, চিন্তা হয়ে যাবে। যদি ভক্তের সঙ্গে রাখ, ঈশ্বরচিন্তা, হরি কথা -- এই সব হবে।

“মন নিয়েই সব। একপাশে পরিবার, একপাশে সন্তান। একজনকে একভাবে, সন্তানকে আর-একভাবে আদর করে। কিন্তু একই মন”৷

Sunday, 8 May 2016

Pictures

নিষ্কামকর্ম বা কর্মযোগ ও জগতের উপকার -- Sri Ramakrishna and the European ideal of work




“পূজা, হোম, যাগ” কিছুই কিছু নয়। যদি তাঁর উপর ভালবাসা আসে, তাহলে আর এ-সব কর্মের বেশি দরকার নাই। যতক্ষণ হাওয়া পাওয়া না যায়, ততক্ষণই পাখার দরকার; যদি দক্ষিণে হাওয়া আপনি আসে, পাখা রেখে দেওয়া যায়। আর পাখার কি দরকার?

“তুমি যে-সব কর্ম করছ, এ-সব সৎকর্ম। যদি ‘আমি কর্তা’ এই অহংকার ত্যাগ করে নিষ্কামভাবে করতে পার, তাহলে খুব ভাল। এই নিষ্কামকর্ম করতে করতে ঈশ্বরেতে ভক্তি ভালবাসা আসে। এইরূপ নিষ্কামকর্ম করতে করতে ঈশ্বরলাভ হয়।

“কিন্তু যত তাঁর উপর ভক্তি ভালবাসা আসবে, ততই তোমার কর্ম কমে যাবে। গৃহস্থের বউ, পেটে যখন ছেলে হয় -- শাশুড়ী তার কর্ম কমিয়ে দেয়। যতই মাস বাড়ে, শাশুড়ী কর্ম কমায়। দশমাস হলে আদপে কর্ম করতে দেয় না, পাছে ছেলের কোন হানি হয়, প্রসবের কোন ব্যাঘাত হয়। (হাস্য) তুমি যে-সব কর্ম করছ এতে তোমার নিজের উপকার। নিষ্কামভাবে কর্ম করতে পারলে চিত্তশুদ্ধি হবে, ঈশ্বরের উপর তোমার ভালবাসা আসবে। ভালবাসা এলেই তাঁকে লাভ করতে পারবে। জগতের উপকার মানুষ করে না, তিনিই করছেন, যিনি চন্দ্র-সূর্য করেছেন, যিনি মা-বাপের স্নেহ, যিনি মহতের ভিতর দয়া, যিনি সাধু-ভক্তের ভিতর ভক্তি দিয়েছেন। যে-লোক কামনাশূন্য হয়ে কর্ম করবে সে নিজেরই মঙ্গল করবে।”

[নিষ্কামকর্মের উদ্দেশ্য -- ঈশ্বরদর্শন ]

“অন্তরে সোনা আছে, এখনও খবর পাও নাই। একটু মাটি চাপা আছে। যদি একবার সন্ধান পাও, অন্য কাজ কমে যাবে। গৃহস্থের বউ-এর ছেলে হলে ছেলেটিকেই নিয়ে থাকে; ওইটিকে নিয়েই নাড়াচাড়া; আর সংসারের কাজ শাশুড়ী করতে দেয় না। (সকলের হাস্য)

“আরও এগিয়ে যাও। কাঠুরে কাঠ কাটতে গিছিল; -- ব্রহ্মচারী বললে, এগিয়ে যাও। এগিয়ে গিয়ে দেখে চন্দনগাছ। আবার কিছুদিন পরে ভাবলে, তিনি এগিয়ে যেতে বলেছিলেন, চন্দনগাছ পর্যন্ত তো যেতে বলেন নাই। এগিয়ে গিয়ে দেখে রূপার খনি। আবার কিছুদিন পরে এগিয়ে গিয়ে দেখে, সোনার খনি। তারপা কেবল হীরা, মাণিক। এই সব লয়ে একেবারে আণ্ডিল হয়ে গেল।

“নিষ্কামকর্ম করতে পারলে ঈশ্বরে ভালবাসা হয়; ক্রমে তাঁর কৃপায় তাঁকে পাওয়া যায়। ঈশ্বরকে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে কথা কওয়া যায়, যেমন আমি তোমার সঙ্গে কথা কচ্ছি!” (সকলে নিঃশব্দ)

Saturday, 7 May 2016

উপায় -- বিশ্বাস

যো মামজমনাদিঞ্চ বেত্তি লোকমহেশ্বরম্‌ ৷
অসংমূঢ়ঃ স মর্তেষু সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে ৷৷
                                                                    [গীতা -- ১০।৩]

উপায় -- বিশ্বাস
একজন ভক্ত -- মহাশয়, এরূপ সংসারী জীবের কি উপায় নাই?
শ্রীরামকৃষ্ণ -- অবশ্য উপায় আছে। মাঝে মাঝে সাধুসঙ্গ আর মাঝে মাঝে নির্জনে থেকে ঈশ্বরচিন্তা করতে হয়। আর বিচার করতে হয়। তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে হয়, আমাকে ভক্তি বিশ্বাস দাও।
বিশ্বাস হয়ে গেলেই হল। বিশ্বাসের চেয়ে আর জিনিস নাই।
(কেদারের প্রতি) -- “বিশ্বাসের কত জোর তা তো শুনেছ? পুরাণে আছে, রামচন্দ্র যিনি সাক্ষাৎ পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণ, তাঁর লঙ্কায় যেতে সেতু বাঁধতে হল। কিন্তু হনুমান রামনামে বিশ্বাস করে লাফ দিয়ে সমুদ্রের পারে গিয়ে পড়ল। তার সেতুর দরকার হয় নাই। (সকলের হাস্য)
“বিভীষণ একটি পাতায় রামনাম লিখে ওই পাতাটি একটি লোকের কাপড়ের খোঁটে বেঁধে দিছল। সে লোকটি সমুদ্রের পারে যাবে। বিভীষণ তাকে বললে, ‘তোমার ভয় নাই, তুমি বিশ্বাস করে জলের উপর দিয়ে চলে যাও, কিন্তু দেখ যাই অবিশ্বাস করবে, অমনি জলে ডুবে যাবে।’ লোকটি বেশ সমুদ্রের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল; এমন সময়ে তার ভারী ইচ্ছা হল যে, কাপড়ের খোঁটে কি বাঁধা আছে একবার দেখে! খুলে দেখে যে, কেবল ‘রামনাম’ লেখা রয়েছে! তখন সে ভাবলে, ‘এ কি! শুধু রামনাম একটি লেখা রয়েছে!’ যাই অবিশ্বাস, অমনি ডুবে গেল।
“যার ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে, সে যদি মহাপাতক করে -- গো, ব্রাহ্মণ, স্ত্রী হত্যা করে, তবুও ভগবানে এই বিশ্বাসের বলে ভারী ভারী পাপ থেকে উদ্ধার হতে পারে। সে যদি বলে আর আমি এমন কাজ করব না, তার কিছুতেই ভয় হয় না।”

Thursday, 5 May 2016

খণ্ডন-ভব-বন্ধন.........


খণ্ডন-ভব-বন্ধন বা শ্রীরামকৃষ্ণ-আরাত্রিক ভজন হল হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি বাংলা গান।এই গানটি ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসের উদ্দেশ্যে রচিত। গানটির রচনাকাল ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ।এটি মিশ্রকল্যাণ রাগ ও তালফেরতায় (চৌতাল, তিনতাল ও একতাল) রচিত একটি ভক্তিগীতি।
এই গানটিতে বিবেকানন্দ জাগতিক বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার, এবং যাঁরা নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছেন তাঁদের বিশ্বব্যাপী মুক্তি-চেতনা ছড়িয়ে দেবার ও বন্ধন ও দুঃখ থেকে মানুষকে মুক্ত হতে অনুপ্রেরিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিবেকানন্দ ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য। রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিক্ষা প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেটি হিন্দু সংস্কার আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। বিবেকানন্দ ছিলেন পাশ্চাত্যে বেদান্ত ও যোগ দর্শনের প্রথম ও অন্যতম প্রধান প্রচারক। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ পর্যটন করে এই দুই দর্শন প্রচার করেছিলেন। ১৮৯৮ সালে রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য নীলাম্বর বসুর বাড়িতে তিনি রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বাড়িতে অবস্থানকালেই তিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন।

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সব মন্দিরেই দৈনিক পূজার্চনার পর সন্ধ্যারতির সময় এই গানটি গাওয়া হয়৷

এই গানে বিবেকানন্দ দুঃখ ও জাগতিক বন্ধন থেকে ব্যক্তির মুক্তির কথা লিখেছেন। তিনি নিজেও তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন এই কাজে অতিবাহিত খণ্ডন-ভব-বন্ধন বা শ্রীরামকৃষ্ণ-আরাত্রিক ভজন হল হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি বাংলা গান।এই গানটি ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসের উদ্দেশ্যে রচিত।গানটির রচনাকাল ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ। এটি মিশ্রকল্যাণ রাগ ও তালফেরতায় (চৌতাল, তিনতাল ও একতাল) রচিত একটি ভক্তিগীতি।

এই গানটিতে বিবেকানন্দ জাগতিক বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার, এবং যাঁরা নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছেন তাঁদের বিশ্বব্যাপী মুক্তি-চেতনা ছড়িয়ে দেবার ও বন্ধন ও দুঃখ থেকে মানুষকে মুক্ত হতে অনুপ্রেরিত করার আহ্বান জানিয়েছেন ৷
এই স্তোত্রে বিবেকানন্দ তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসকে সম্বোধন করে বন্দনা করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর গুরু এমনই এক নিষ্কলুষ চরিত্র যিনি জগতের সকল বন্ধন খণ্ডন করতে সমক্ষ; তিনি মানুষের রূপধারী দিব্য জ্ঞানের প্রতিনিধি। গুরুর চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি অনুভব করেছেন, তাঁর চোখদুটি ঐশ্বরিক জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত এবং মায়াখণ্ডনকারী। মানুষকে মুক্ত করতে তিনি নিজে এই মানবদেহে বন্দী হয়ে এসেছেন। তাই তিনি তাঁর গুরুকে পুনরায় বন্দনা করেছেন। শেষে তিনি তাঁর গুরুকে "জ্যোতির জ্যোতি" বলে উল্লেখ করে তাঁর হৃদয়ের অন্ধকার ও অজ্ঞান দূর করার জন্য গুরুর কাছে প্রার্থনা করেছেন।








Monday, 2 May 2016

আমার ভিতরে যে আগুন জ্বলছে, তা তোমাদের ভিতর জ্বলে উঠুক........



নাম-যশ চুলোয় যাক ৷ কাজে লাগো, সাহসী যুবকবৃন্দ, কাজে লাগো ৷.... দূর করে দাও যত আলস্য, দূর করে দাও ইহলোক ও পরলোক ভোগের বাসনা ৷ আগুনে গিয়ে ঝাঁপ দাও ৷ আমার ভিতরে যে আগুন জ্বলছে, তা তোমাদের ভিতর জ্বলে উঠুক, তোমাদের মন-মুখ এক হোক -- ভাবের ঘরে চুরি যেন একদম না থাকে ৷ তোমরা যেন জগতের যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো মরতে পারো -- এটাই সবসময় বিবেকানন্দের প্রার্থনা ৷