Sunday, 10 July 2016

হিন্দুধর্ম

১৯শে সেপ্টেম্বর, নবম দিবসের অধিবেশনে স্বামীজী এই প্রবন্ধটি পাঠ করেন।
হিন্দু, জরথুষ্ট্রীয় ও ইহুদী -এই তিনটি ধর্মই প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতে বর্তমান কাল অবধি এই পৃথিবীতে প্রচলিত রহিয়াছে। এই ধর্মগুলির প্রত্যেকটিই প্রচন্ড আঘাত সহ্য করিয়াছে, তথাপি লুপ্ত না হইয়া এগুলি যে এখও জীবিত আছে, তাহাতেই প্রমাণিত হইতেছে যে, ইহাদের মধ্যে মহতী শক্তি নিহিত আছে। কিন্তু একদিকে যেমন ইহুদী-ধর্ম তৎপ্রসূত খ্রীষ্টধর্মকে আত্মসাৎ করিতে পারা তো দূরের কথা, নিজেই ঐ সর্বজয়ী ধর্ম দ্বারা স্বীয় জন্মভূমি হইতে বিতাড়িত হইয়াছ, এবং অতি অল্পসংখ্যক পারসী মাত্র এখন মহান জরথুষ্টীয় ধর্মের সাক্ষিস্বরূপ হইয়া রহিয়াছে; অপরদিকে আবার ভারতবর্ষে সম্প্রদায়ের পর সম্প্রদায় উত্থিত হইয়াছে, মনে হইয়াছে যেন বেদোক্ত ধর্মের ভিত্তি পর্যন্ত নড়িয়া গেল; কিন্তু প্রচণ্ড ভূমিকম্পের সময় সাগরসলিল যেমন কিছু পশ্চাৎপদ হইয়া সহস্রগুণ প্রবল বেগে সর্বগ্রাসী বন্যারূপে ফিরিয়া আসে, সেইরূপ ইহাদের জননীস্বরূপ বেদোক্ত ধর্মও প্রথমতঃ কিঞ্চিৎ পশ্চাৎপদ হইয়া আলোড়নের অগ্রগতি শেষ হইলে ঐ সম্প্রদায়গুলিকে সর্বতোভাবে আত্মসাৎ করিয়া নিজের বিরাট দেহ পুষ্ট করিয়াছে।
বিজ্ঞানের অতি আধুনিক আবিষ্ক্রিয়াসমূহ বেদান্তের যে মহোচ্চ আধ্যাত্মিক ভাবের প্রতিধ্বনি মাত্র, সেই সর্বোৎকৃষ্ট বেদান্তজ্ঞান হইতে নিম্নস্তরের মূর্তিপূজা ও আনুষঙ্গিক নানাবিধ পৌরাণিক গল্প পর্যন্ত সবকিছুরই, এমন কি বৌদ্ধদের অজ্ঞেয়বাদ, জৈনদের নিরীশ্বরবাদ-এগুলিরও স্থান হিন্দুধর্মে আছে। এখন প্রশ্ন হইতে পারে, এই সকল বহুধা বিভিন্ন ভাব কোন্ সাধারণ কেন্দ্রে সংহত হইয়াছে? কোন্ সাধারণ ভিত্তি আশ্রয় করিয়া এই আপাতবিরোধী ভাবগুলি অবস্থান করিতেছে? আমি এখন এই প্রশ্নেরই মীমাংসা করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।
আপ্তবাক্য বেদ হইতে হিন্দুগণ তাঁহাদের ধর্ম লাভ করিয়াছেন। তাঁহারা বেদসমূহকে অনাদি ও অনন্ত বলিয়া বিশ্বাস করেন। একখানি পুস্তককে অনাদি ও অনন্ত বলিলে এই শ্রোতৃনণ্ডলীর কাছে তাহা হাস্যকর বলিয়া মনে হইতে পারে বটে, কিন্তু ‘বেদ’ শব্দদ্বারা কোন পুস্তক-বিশেষ বুঝায় না। ভিন্ন ভিন্ন ব্যাক্তি বিভিন্ন সময়ে যে আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন, বেদ সেই-সকলের সঞ্চিত ভান্ডারস্বরূপ। আবিষ্কৃত হইবার পূর্বেও মাধ্যাকর্ষণের নিয়মাবলী যেমন সর্বত্রই বিদ্যমান ছিল এবং সমুদয় মনুষ্য-সমাজ ভুলিয়া গেলেও যেমন ঐগুলি বিদ্যমান থাকিবে, আধ্যাত্মিক জগতের নিয়মাবলীও সেইরূপ। আত্মার সহিত আত্মার যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ, প্রত্যেক জীবাত্মার সহিত সকলের পিতাস্বরূপ পরমাত্মার যে দিবা সম্বন্ধ, আবিষ্কৃত হইবার পূর্বেও সেগুলি ছিল এবং সকলে বিস্মৃত হইয়া গেলেও এগুলি থাকিবে।
এই আধ্যাত্মিক সত্যগুলির আবিষ্কারকগণের নাম ‘ঋষি’। আমরা তাঁহাদিগকে সিদ্ধ বা পূর্ণ বলিয়া ভক্তি ও মান্য করি। আমি এই শ্রোতৃমন্ডলীকে অতি আনন্দের সহিত বলিতেছি যে, অতিশয় উন্নত ঋষিদের মধ্যে কয়েকজন নারীও ছিলেন।
এ-স্থলে এরূপ বলা যাইতে পারে যে, উক্তআধ্যাত্মিক নিয়মাবলী নিয়মরূপে অনন্ত হইতে পারে, কিন্তু অবশ্যই তাহাদের আদি আছে। বেদ বলেন -সৃষ্টি অনাদি ও অনন্ত। বিজ্ঞানও প্রমাণ করিয়াছে যে, বিশ্বশক্তির সমষ্টি সর্বদা সমপরিমান। আচ্ছা, যদি এমন এক সময়ের কল্পনা করা যায়, যখন কিছুই ছিল না, তবে এই সকল ব্যক্ত শক্তি তখন ছিল কোথায়? কেহ বলিবেন যে এগুলি অব্যক্ত অবস্হায় ঈশ্বরেই ছিল। তাহা হইলে বলিতে হয়-ঈশ্বর কখনও সুপ্ত বা নিষ্ক্রিয়, কখনও সক্রিয় বা গতিশীল; অর্থাৎ তিনি বিকারশীল! বিকারশীল পদার্থমাত্রই মিশ্র পদার্থ এবং মিশ্র-পদার্থমাত্রই ধ্বংস-নামক পরিবর্তনের অধীন। তাহা হইলে ঈশ্বরেরও মৃত্যু হইবে; কিন্তু তাহা অসম্ভব। সুতরাং এমন সময় কখনও ছিল না, যখন সৃষ্টি ছিল না; কাজেই সৃষ্টি অনাদি।
কোন উপমা দ্বারা বুঝাইতে হইলে বলিতে হয় -সৃষ্টি ও স্রষ্টা দুইটি অনাদি ও অনন্ত সমান্তরাল রেখা। ঈশ্বর শক্তিস্বরূপ-নিত্যসক্রিয় বিধাতা; তাঁহারই নির্দেশে বিশৃঙ্খল প্রলয়াবস্থা হইতে একটির পর একটির পর একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ জগৎ সৃষ্ট হইতেছে, কিচুকাল চালিত হইতেছে, পুনরায় ধ্বংস হইয়া যাইতেছে। হিন্দুবালক গুরুর সহিত প্রতিদিন আবৃত্তি করিয়া থাকেঃ ‘সূর্যাচন্দ্রমসৌ ধাতা যথাপূর্বমকল্পয়ৎ।’-অর্থাৎ বিধাতা পূর্ব-পূর্ব কল্পের সূর্য ও চন্দ্রের মতো এই সূর্য ও চন্দ্র সৃষ্টি করিয়াছেন। ইহা আধুনিক বিজ্ঞানসন্মত।
আমি এখানে দাঁড়াইয়া আছি। যদি চক্ষু মুদ্রিত করিয়া আমার সত্তা সম্বন্ধে চিন্তা করিবার চেষ্টা করি-‘আমি’ ‘আমি’ ‘আমি’,তাহা হইলে আমার মনে কি ভাবের উদয় হয়? এই দেহই আমি-এই ভাবই মনে আসে। তবে কি আমি জড়ের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নই? বেদ বলিতেছেন : না, আমি এই দেহ নই। দেহ মরিবে,কিন্তু আমি মরিব না। আমি এই দেহের মধ্যে আছি, কিন্তু যখন এই দেহ মরিয়া যাইবে তখনও আমি বাঁচিয়া থাকিব এবং এই দেহের জন্মের পূর্বেও আমি ছিলাম। আত্মা শূন্য হইতে সৃষ্ট নয়, কারণ ’সৃষ্টি’ শব্দের অর্থ বিভিন্ন দ্রব্যের সংযোগ; ভবিষ্যতে এগুলি নিশ্চয়ই আবার বিচ্ছিন্ন হইবে। অতএব আত্মা যদি সৃষ্ট পদার্থ হন, তাহা হইলে তিনি মরণশীলও বটে। সুতরাং আত্মা সৃষ্ট পদার্থ নন।
কেহ জন্মিয়া অবধি সুখভোগ করিতেছে- শরীর সুস্থ ও সুন্দর, মন উৎসা্হপূর্ণ, কিছুরই অভাব নাই; আবার কেহ জন্মিয়া অবধি দুঃখভোগ করিতেছে-কাহারও হস্ত-পদ নাই, কেহ বা জড়বুদ্ধি এবং অতি কষ্টে জীবন যাপন করিতেছে।
যখন সকলেই এক ন্যায়পরায়নণ ও করুণামায় ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্ট, তখন কেহ সুখী এবং কেহ দুঃখী হইল কেন? ভগবান কেন এত পক্ষপাতী? যদি বলো যে, যাহারা এজন্মে দুঃখভোগ করিতেছে, পরজন্মে তাহারা সুখী হইবে, তাহাতে অবস্থার কিছু উন্নতি হইল না। দয়াময় ও ন্যায়পরায়ণ ঈশ্বরের রাজ্যে একজনও কেন দুঃখভোগ করিবে? দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকে এভাবে দেখিলে এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর সৃষ্টির অন্তর্গত অসঙ্গতির কোন কারণ প্রদর্শন করার চেষ্টাও লক্ষিত হয় না; পরন্তু এক সর্বশক্তিমান্ স্বেচ্ছাচারী পুরুষের নিষ্ঠুর আদেশেই স্বীকার করিয়া লওয়া হইল। স্পষ্টতই ইহা অবৈজ্ঞানিক। অতএব স্বীকার করিতে হইবে সুখী বা দুঃখী হইয়া জন্মিবার পূর্বে নিশ্চয় বহুবিধ কারণ ছিল, যাহার ফলে জন্মের পর মানুষ সুখী বা দুঃখী হয়; তাহার নিজের পূর্বজন্মের কর্মসমূ্হই সেই-সব কারণ।
দেহ-মনের প্রবণতা মাতাপিতার দেহ-মনের প্রবণতা হইতেই উত্তরাধিকারসূত্রে লব্ধ হয় না কি? দেখা যাইতেছে যে, দুইটি সত্ত্বা সমান্তরাল রেখায় বর্তমান-একটি মন, অপরটি স্থূল পদার্থ। যদি জড় ও জড়ের বিকার দ্বারাই আমাদের অন্তর্নিহিত সকল ভাব যথেষ্টভাবে ব্যাখ্যাত হয়, তবে আর আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করিবার কোন আবশ্যকতা থাকিতে পারে না। কিন্ত জড় হইতে চিন্তা উদ্ভূত হইয়াছে-ইহা প্রমাণ করা যায় না, এবং যদি দার্শনিক দৃষ্টিকোণ হইতে একত্ববাদ অপরিহার্য হয়, তবে আধ্যাত্মিক একাত্ববাদ নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত এবং জড়বাদী একাত্ববাদ অপেক্ষা ইহা কম বাঞ্ছনীয় নয়; কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে এ দুইটির কোনটিরই প্রয়োজন নাই।
আমরা অস্বীকার করিতে পারি না, শরীরমাত্রেই উত্তরাধিকারসূত্রে কতকগুলি প্রবণতা লাভ করে, কিন্তু সেগুলি সম্পূর্ণ দৈহিক। এই দৈহিক প্রবণতার মাধ্যমেই মনের বিশেষ প্রবণতা ব্যক্ত হয়। মনের এরূপ বিশেষ প্রবণতার কারণ পূর্বানুষ্ঠিত কর্ম। বিশেষ কনো প্রবণতাসম্পন্ন জীব সদৃশবস্তুর প্রতি আকর্ষণের নিয়মানুসারে এমন এক শরীরে জন্মগ্রহণ করিবে, যাহা তাহার ঐ প্রবণতা বিকশিত করিবার সর্বশ্রেষ্ঠ সহায় হয়। ইহা সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞান-সম্মত, কারণ বিজ্ঞান অভ্যাস দ্বারা সব কিছু ব্যাখ্যা করিতে চায়, অভ্যাস আবার পুনঃপুনঃ অনুষ্ঠানের ফল। সুতরাং অনুমান করিতে হইবে, নবজাত প্রাণীর স্বভাবও তাহার পুনঃপুনঃ অনুষ্ঠিত কর্মের ফল; এবং যেহেতু তাহার পক্ষে বর্তমান জীবনে ঐগুলি লাভ করা অসম্ভব, অতএব অবশ্যই পূর্ব জীবন হইতেই ঐতুলি আসিয়াছে।
আর একটি প্রশ্নের ইৃঙ্গিত আছে। স্বীকার করা গেল পূর্বজন্ম আছে, কিন্তু পূর্ব জীবনের বিষয় আমাদের মনে থাকে না কেন? ইহা সহজেই বুঝানো যাইতে পারে। আমি এখন ইংরাজীতে কখা বলিতেছি, ইহা আমার মাতৃভাষা নয়। বাস্তবিক এখন আমার চেতন-মনে মাতৃভাষার একটি অক্ষরও নাই। কিন্তু যদি আমি মনে করিতে চেষ্টা করি, তাহা হইলে উহা এখনই প্রবল বেগে মনে উঠিবে। এই ব্যাপারে বুঝা যাইতেছে, মনঃসমুদ্রের উপরিভাগেই চেতন-ভাব অনুভূত হয় এবং আমাদের পূর্বার্জিত অভিজ্ঞতা সেই সমুদ্রের গভীরদেশে সঞ্চিত থাকে।
চেষ্টা ও সাধনা কর, ঐগুলি সব উপরে উঠিয়া আসিবে, এমন কি পূর্বজন্ম সম্বন্ধেও তুমি জানিতে পারিবে।
পূর্বজন্ম সম্বন্ধে ইহাই সাক্ষাৎ ও পরীক্ষামূলক প্রমাণ। কার্যক্ষেএে সত্যতা নির্ণীত হইলেই কোন মতবাদ সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত হয়, এবং ঋষিগণ সমগ্র জগতে সদর্পে ঘোষণা করিতেছেন : স্মৃতিসাগরের গভীরতম প্রদেশ কিরূপে অলোড়িত করিতে হয়, সেই রহস্য আমরা আবিষ্কার করিয়াছি। সাধনা কর, তোমরাও পূর্বজন্মের সকল কথা মনে করিতে পারিবে।
অতএব দেখা গেল, হিন্দু নিজেকে আত্মা বলিয়া বিশ্বাস করে। ‘সেই আত্মাকে তরবারি ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না, জল আর্দ্র করিতে পারে না এবং বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না।’ হিন্দু বিশ্বাস করে : সেই আত্মা এমন একটি বৃত্ত, যাহার পরিধি কোথাও নাই, কিন্তু যাহার কেন্দ্র দেহমধ্যে অবস্থিত, এবং সেই কেন্দ্রের দেহ হইতে দেহান্তরে গমনের নামই মৃত্যু। আর আত্মা জড়নিয়মের বশীভূত নন, আত্মা নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাব। কিন্তু কোন কারণবশতঃ জড়ে আবদ্ধ হইয়াছেন ও নিজেকে জড় মনে করিতেছেন।
পরবর্তী প্রশ্ন : কেন এই শুদ্ধ পূর্ণ ও মুক্ত আত্মা জড়ের দাসত্ব-নিগড়ে আবদ্ধ? পূর্ণ হইয়াও কেন তিনি নিজেকে অপূর্ণের ন্যায় মনে করিতেছেন? শুনিয়াছি, কেহ কেহ মনে করেন-এই প্রশ্নের যথাযথ মীমাংসা করিতে পারিবেন না বলিয়া হিন্দুগণ উহা এড়াইয়া চলিতে চেষ্টা করেন। কোন কোন পন্ডিত আত্মা ও জীব-এই দুয়ের মধ্যে কতকগুলি পূর্ণকল্প সত্তার অস্তিত্ব কল্পনা করিয়া এ প্রশ্নের মীমাংসা করিতে চান এবং শূন্যস্থান পূর্ণ করিতে বহুবিধ সুদীর্ঘ বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা ব্যবহার করেন। কিন্তু সংজ্ঞা দিলেই ব্যাখ্যা করা হয় না। প্রশ্ন যেমন তেমনি রহিল। যিনি পূর্ণ, তিনি কেমন করিয়া পূর্ণকল্প হইতে পারেন? যিনি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাব, কেমন করিয়া তাঁহার সেই স্বভাবের অণুমাত্র ব্যতিক্রম হয়? হিন্দুগণ এ সম্বন্ধে সরল ও সত্যবাদী। তাঁহারা মিথ্যা তর্কযুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করিতে চাহেন নাই। তাঁহারা সাহসের সহিত এই প্রশ্নের সন্মুখীন হন এবং উত্তরে বলেন, ‘জানি না, কেমন করিয়া পূর্ণ আত্মা নিজেকে অপূর্ণ এবং জড়ের সহিত যুক্ত ও জড়ের নিয়মাধীন বলিয়া মনে করেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ব্যাপারটি তো অনুভূত সত্য। প্রত্যকেই তো নিজিকে দেহ বলিয়া মনে করে।’ কেন এরূপ হইল, কেনই বা আত্মা এই দেহে রহিয়াছেন, এ তত্ত্ব তাঁহারা ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করেন না। ইহা ঈশ্বরের ইচ্ছা-এরূপ বলিলে কিছুই ব্যাখ্যা করা হইল না। হিন্দুরা যে বলেন, ‘আমরা জানি না’, তাহা অপেক্ষা এই উত্তর আর বেশী কিছু নয়।

Tuesday, 5 July 2016

ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়

ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়

সূর্য যদি মেঘাচ্ছন্ন হয় কিছুক্ষণ 
যদি বা আকাশ হের বিষণ্ণ গম্ভীর, 
ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়, 
         জয় তব জেনো সুনিশ্চয় ৷
শীত যায়, গ্রীষ্ম আসে তার পাছে পাছে,
ঢেউ পড়ে, ওঠে পুন তারি সাথে সাথে, 
আলো ছায়া আগাইয়া দেয় পরস্পরে; 
            হও তবে ধীর, স্থির, বীর ৷
জীবনকর্তব্য-ধর্ম  বড় তিক্ত জানি,
জীবনের সুখচয় বৃথা ও চঞ্চল,
লক্ষ্য আজ বহুদূরে ছায়ায় মলিন ; 
তবু চল অন্ধকারে হে বীর হৃদয়, 
              সবটুকু শক্তি সাথে লয়ে ৷
কর্ম নষ্ট নাহি হবে, কোন চেষ্টা হবে না বিফল,
আশা হোক উন্মূলিত, শক্তি - অস্তমিত,
কটিদেশ হতে তব জনমিবে উত্তরপুরুষ,
ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়
      কল্যাণের নাহিক বিলয় ৷
জ্ঞানী গুণী মুষ্টিমেয় জীবনের পথে --
তবুও তাঁরাই হেথা হন কর্ণধার,
জনগন তাঁহাদের বোঝে বহু পরে; 
        চাহিও না কারো পানে,ধীরে লয়ে চল ৷
সাথে তব ক্রান্তদর্শী দূরদর্শী যাঁরা,
সাথে তব ভগবান সর্বশক্তিমান, 
আশিষ ঝরিয়া পড়ে তব শিরে-তুমি মহাপ্রাণ -
   সত্য হোক, শিব হোক সকলি তোমার ৷
 Hold on Yet a While, Brave Heart: খেতড়ি-মহারাজকে লিখিত ৷
অনুবাদ : ব্রহ্মচারী পূর্ণচৈতন্য ৷

আত্মা ও ঈশ্বর

               
যাহা কিছু স্থান ব্যাপ্ত করিয়া আছে, তাহারই রূপ আছে ৷ স্থান (দেশ)নিজেই রূপ বা আকার ধারণ করে ৷ হয় তুমি স্থানের (দেশের)মধ্যে অবস্থিত, নতুবা স্থান তোমাতে অবস্থিত ৷ আত্মা সর্বপ্রকার দেশের অতীত ৷ দেশ আত্মায়  অবস্থিত, আত্মা দেশে অবস্থিত নয় ৷
    আকার বা রূপ  কাল ও দেশের দ্বারা সীমাবদ্ধ  এবং কার্য-কারণের দ্বারা আবদ্ধ ৷ সমুদয় কাল আমাদের মধ্যে বিদ্যমান, আমরা কালের মধ্যে অবস্থিত নই ৷ যেহেতু আত্মা স্থান ও কালের মধ্যে অবস্থিত নন, সমুদয় কাল ও দেশ আত্মায় অবস্থিত; অতএব আত্মা সর্বব্যাপী ৷
  ঈশ্বর-সম্বন্ধে আমাদের ধারণা আমাদের নিজ নিজ চিন্তার প্রতিচ্ছবি ৷ 
  প্রকৃতির বিভিন্ন রূপের সহিত ঈশ্বরের অভেদ কল্পনা অর্থাৎ প্রকৃতি-পূজাই ছিল ঈশ্বর-সম্বন্ধে প্রাচীন যুগের ধারণা ৷ পরবর্তী ধাপ হইল গোষ্ঠীগত দেবতা ৷ রাজাকে ঈশ্বর-জ্ঞানে পূজা করা হইল পরবর্তী ক্রম ৷
  ঈশ্বর স্বর্গে অবস্থান করেন - এই ধারণা ভারতবর্ষ ব্যতীত সকল জাতির মধ্যেই প্রবল ৷ ঐ ধারণা অত্যন্ত অপরিণত ৷
  অবিচ্ছিন্ন জীবনের কল্পনা হাস্যজনক ৷ যে পর্যন্ত আমরা জীবন হইতে মুক্তি লাভ না করি, সে পর্যন্ত মৃত্যু হইতেও মুক্তি নাই ৷

স্বামীজীর বাণী ও রচনা
১০ম খণ্ড, পৃ: ১৫৯